বাংলা সালতানাত প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট

0 ৪৪

১৩২৫ সালে  সুলতান মুহাম্মাদ ইবনে তুঘলক শাহ দিল্লীতে বন্দি গৌড়ের বলবানী সুলতান বাহাদুর শাহ কে মুক্তি দেন এবং তাঁকে শর্তসাপেক্ষে বঙ্গ (পূর্ব বাংলা) শাসনের অনুমতি প্রদান করেন। শর্ত ছিলো এই যে, খুতবায় তাঁর নামের পাশাপাশি অধিরাজ হিসেবে দিল্লীর সুলতান মুহাম্মাদ ইবনে তুঘলকের নামও উচ্চারণ করতে হবে। সেই সাথে মুদ্রায় নিজের নামের সাথে দিল্লীর সুলতানের নামও খোদাই করতে হবে। অর্থাৎ বাহাদুর শাহ স্বাধীন থাকবেন ঠিকই কিন্তু ‘সার্বভৌমত্ব’ হারাবেন!

যিনি গৌড়ের বিখ্যাত সুলতান শামসউদ্দিন ফিরোজ শাহের পুত্র, যিনি ছিলেন হিন্দুস্তানের বিখ্যাত সুলতান গিয়াসউদ্দিন বলবনের বংশধর,  তাঁর জন্য তুঘলকদের বশ্যতা স্বীকার করা ছিলো অত্যন্ত অপমানের! তথাপি বাহাদুর শাহ্ তাঁর প্রস্তাবে রাজি হন এবং চলে আসেন বঙ্গের প্রাণকেন্দ্র সোনারগাঁও-এ।

৩ বছর পর ১৩২৮ খ্রিস্টাব্দের শেষদিকে স্বাধীনচেতা সুলতান  গিয়াসউদ্দিন বাহাদুর শাহ বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। পরাক্রমশালী দিল্লী সালতানাতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার মতো শক্তি-সামর্থ্য কোনোটাই সেইসময় ছিলো না বাহাদুর শাহর! এরপরেও  বলবানী বংশধর বাহাদুর শাহ্ বিদ্রোহের ঘোষণা করেন।

হিন্দুস্তানের সুলতান মুহাম্মাদ ইবনে তুঘলক শাহ এই বিদ্রোহ দমনের জন্য প্রেরণ করেন বিশাল বাহিনী। তুঘলক বাহিনী এবং বাহাদুর শাহর  বাহিনী মুখোমুখি হয় বর্তমান বাংলাদেশের গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে।

এই যুদ্ধে সুলতান বাহাদুর শাহ পরাজিত ও বন্দি হন এবং তাঁকে শিরশ্ছেদ করে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। বাহাদুর শাহর চামড়া ছাড়িয়ে সেই চামড়া ও কর্তিত মস্তক পাঠানো হয় দিল্লীর শাহী দরবারে! বাহাদুর শাহর চামড়া দিল্লীর বিজয় গম্বুজে টানাবার নির্দেশ দেন সুলতান মুহাম্মাদ ইবনে তুঘলক শাহ।

বাহাদুর শাহের বিদ্রোহ দমনের পর বাংলা কে বিদ্রোহমুক্ত রাখতে সুলতান মুহাম্মাদ ইবনে তুঘলক বাংলাকে তিন প্রদেশে বিভক্ত করে তিনজন গভর্নর নিযুক্ত করেন।

এই তিন প্রদেশ হলো— ১. গৌড় ২. বঙ্গ ও ৩. রাঢ় 

গৌড়ের প্রাদেশিক রাজধানী ছিলো লখনৌতি, বঙ্গের রাজধানী সোনারগাঁও ও রাঢ়ের রাজধানী সাতগাঁও

গৌড়ের শাসনকর্তা হিসেবে মালিক কদর খান কে নিযুক্ত করা হয়। বঙ্গের গভর্নর নিযুক্ত করা হয় সুলতানের পালক ভাই বাহরাম খান কে এবং রাঢ়ের গভর্নর নিয়োগ দেওয়া হয় আজম-উল-মুলক ইজাজউদ্দিন ইয়াহিয়া কে।

১৩৩৮ সালে বঙ্গের গভর্নর মালিক বাহরাম খান মৃত্যুবরণ করলে তাঁর সিলাহদার ফখরা সোনারগাঁও-এর ক্ষমতা দখল করেন এবং  ‘ফখর-উদ্ব-দ্বীন মুবারক শাহ’ নাম ধারণ করে নিজেকে স্বাধীন সুলতান ঘোষণা করেন।

বাহাদুর শাহর বিদ্রোহ দমনের ১০ বছর পর  বাংলার  সোনারগাঁও-এ জ্বলে উঠলো আরেকটি বিদ্রোহের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ!

সুলতান ফখরউদ্দিন মুবারক শাহর বিদ্রোহের খবর পেয়ে গৌড় ও রাঢ়ের গভর্নরদের কে নির্দেশ দেওয়া হলো বিদ্রোহ দমনের জন্য। মালিক কদর খান ও আজম-উল-মুলক ইয়াহিয়া স্ব-স্ব সৈন্যবাহিনী নিয়ে  যাত্রা করলেন সোনারগাঁও অভিমুখে। দুই পক্ষের সম্মিলিত বাহিনীর আক্রমণে সুলতান মুবারক শাহ পরাজিত হয়ে পিছু হটলেন ও দক্ষিণে নোয়াখালী-ফেনী অঞ্চলে আশ্রয় নিলেন।

 সোনারগাঁও থেকে লুণ্ঠিত সম্পদ নিয়ে ইয়াহিয়া সাতগাঁও ফিরে গেলেও কদর খান  থেকে গেলেন সোনারগাঁও-এই।

কদর খান একটি নিন্দনীয় কাজ করেছিলেন। তা হলো– সোনারগাঁও থেকে লুণ্ঠিত সম্পদ সব নিজের কাছেই জমা করে রেখেছিলেন। সৈন্যদের তাদের প্রাপ্য ভাগ প্রদান করেন নি। ফলে সৈনিকরা ক্ষুব্ধ ছিলো ও ভেতরে ভেতরে ক্ষোভে ফুঁসে উঠছিলো।

বর্ষা মৌসুমে নদীবহুল পূর্ব-বাংলার নদ-নদীসমূহ দানবে রূপান্তরিত হয় এবং খালগুলোও যেন পরিণত হয় নদীতে। এই সময় অশ্বারোহী বাহিনী অচল হয়ে পড়ে কেননা কর্দমাক্ত মাটি ঘোড়ার চলাচলের অনুপযুক্ত। ঠিক একই ঘটনা ঘটলো কদর খানের সাথে। বর্ষা আসতেই তাঁর অশ্বারোহী বাহিনী অচল হয়ে পড়লো। এই সময় সুলতান মুবারক শাহ দক্ষিণাঞ্চল থেকে শক্তিশালী নৌবাহিনী নিয়ে সোনারগাঁও আক্রমণ করলেন।

এইসময় সম্পদের ভাগ না পাওয়ায় ক্ষুব্ধ সৈন্যরা বিদ্রোহের ডাক দিয়ে মুবারক শাহর  সাথে যোগ দেন এবং তারাই কদর খান কে হত্যা করেন। ফলে সুলতান ফখরউদ্দিন মুবারক শাহ্ সোনারগাঁও পুনর্দখল করতে সক্ষম হন।

লেখক: রাজিত তাহমীদ জিত

তথ্যসূত্র:
১. বাংলার প্রাথমিক যুগের স্বাধীন সুলতানদের মুদ্রা ও কালক্রম — নলিনীকান্ত ভট্টশালী 
২. বাংলার ইতিহাসের দুশো বছর : স্বাধীন সুলতানদের আমল — অধ্যাপক সুখময় মুখোপাধ্যায়

Visits: 0

মন্তব্য
Loading...
//shaveeps.net/4/4139233