যমযম কূপ পুনরাবিষ্কার

0 ৯৯

মক্কায় যমযম কূপ সৃষ্টির পর, ইয়েমেনের জোরহোম গোত্রের কিছুসংখ্যক লোক ইসমাইল (আঃ) এর মাতা হযরত হাজারের অনুমতিক্রমে এবং যমযম কূপের উপর তাঁর মালিকানার স্বীকৃতির শর্তে মক্কায় বসবাস শুরু করে। পরে ইসমাঈল (আ) বড় হন। বনু জোরহোম গোত্র থেকে আরবি ভাষা শিক্ষালাভ করেন এবং জোরহোম গোত্রে বিয়ে করেন। এভাবে ইসমাইল (আঃ) ও বনু জোরহোম গোত্রের মাঝে আত্মীয়তার সম্পর্ক গড়ে উঠে। এরপর ইসমাইল (আঃ) এর মৃত্যুর পর থেকে জোরহোম গোত্র ‘যমযম’ কূপসহ মক্কার শাসনভার পরিচালনা করে। দীর্ঘদিন যাবত যমযম কূপের সূচনালগ্ন থেকেই তারা যমযম কূপের পানি পান করতে থাকে ।

এক পর্যায়ে যমযম কূপ শুকিয়ে যায় ও মাটির নীচে চাপা পড়ে যায় এবং এর সকল চিহ্ন বা নিদর্শন বিলুপ্ত হয়ে যায়। যমযমের বিলুপ্তি সম্পর্কে ইয়াকুত আল হামাগুয়ী বলেছেন, বৃষ্টির অভাবে যমযম শুকিয়ে বিলুপ্ত হয়ে যায় এবং শেষ পর্যন্ত এর কোন চিহ্ন অবশিষ্ট থাকেনি। কিন্তু ঐতিহাসিকরা বলেছেন, এটা ভৌগোলিক কিংবা প্রাকৃতিক কারণে চাপা পড়েনি। বরং জোরহোম গোত্র পবিত্র হারাম শরীফের অসম্মান করে এবং এর প্রতি হাজীদের প্রদত্ত উপহার সামগ্রী প্রকাশ্য ও গোপনে চুরি ও আত্মসাৎ করে। তাদের এই বিরাট পাপের কারণে যমযম কূপ শুকিয়ে যায়। পরবর্তীতে মক্কায় বন্যার কারণে এর সকল চিহ্ন মিটে যায়।

বর্ণিত আছে যে, আমর বিন হারেস বিন মুদাদ বিন আমর জোরহোমী তাঁর গোত্রের লোকদেরকে এসকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে উপদেশ দেন। তিনি পবিত্র হারাম শরীফের সম্মান পুনরুদ্ধার করার প্র‍য়াস চালান। কিন্তু তারা তাতে সাড়া না দেয়ায় তিনি কাবার ধনভাণ্ডারে রক্ষিত দুটো সোনার হরিণের প্রতিকৃতি এবং তলোয়ার যমযম কূপে গোপনে রাত্রে দাফন করেন। তিনি অন্যদের ভয়ে গোপনে কূপটি ভরাট করেন। কেননা, তারা টের পেলে তাকে কিছুতেই ঐ কাজ করতে দিবেনা । তারপর আল্লাহ এই পাপী জাতির উপর বনু খোযাআ গোত্রকে বিজয়ী করেন এবং জোরহোম গোত্র মক্কা থেকে বিতাড়িত হয়। এইভাবে যমযম কূপের আর কোন চিহ্ন অবশিষ্ট থাকেনি।

কোন কোন ঐতিহাসিক বলেছেন, মক্কার একজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি মুসান বিন আমর জোরহোমী তার শত্রুদের সাথে লড়াইতে পরাজিত হন। তার আশংকা হল যে, শত্রুবাহিনী তাকে মক্কায় থাকতে দেবে না।তাই তিনি তাদেরকেও যমযম কূপের পানি থেকে বঞ্চিত করার উদ্দেশ্যে নিজের কিছু মূল্যবান সম্পদ এবং সোনা দিয়ে কূপটি ঢেকে ফেলেন। তারপর মুদাদ জোরহোম গোত্রের আদি বাসস্থান ইয়েমেনে ভেগে যায়। বন্যায় মরুভূমির ধূলাবালুতে ভর্তি হয়ে যায়। ফলে, কূপের চিহ্ন মুছে যায়। পরে কারো পক্ষে আর কূপটি আবিষ্কার করা সম্ভব হয়নি।

মক্কায় যেহেতু নদী-নালা নেই, তাই মক্কাবাসীরা মক্কার বাইরে কূপ খনন করে পানির ব্যবস্থা করতে বাধ্য হয়। কোরাইশ বংশের প্রতিষ্ঠাতা কুসাই বিন কিলাব চামড়ার মশকে করে মক্কার বাইর থেকে পানি সংগ্রহ করে হাজীদেরকে পান করাতেন। পরে কুসাই উম্মে হানী বিনতে আবি তালেবের ঘরের স্থলে আল-আজুল নামক একটি কূপ খনন করে হাজীদেরকে পানি পান করানোর ব্যবস্থা করেন। ইতিহাসে এটিই হচ্ছে মক্কার ভেতরের প্রথম মানবসৃষ্ট প্রথম কূপ। মক্কাবাসী এবং বহিরাগত হাজীরা কুসাই এর এই মহতী কাজের বিশেষ প্রশংসা করেন। কুসাইর মৃত্যুর পরেও দীর্ঘ দিন পর্যন্ত কূপটি অব্যাহত থাকে। কিন্তু পরে এতে বনি জোয়াইল গোত্রের এক ব্যক্তি পড়ে মারা যাওয়ায় তা ভরাট করে দেয়া হয় এবং এরপর প্রত্যেক গোত্র কূপ খনন করে নিজেদের পানির ব্যবস্থা করে। বনু তামীম বিন মুররাহ ‘আল-জোফার’ কূপ, আবদ শামস বিন আবদ মন্নাফের ‘তাওয়া’ কূপ এবং হাশেমী গোত্র ‘সিজলাহ’ নামক কূপ নির্মাণ করে। এইভাবে মক্কায় পানি সমস্যার সমাধানের চেষ্টা চলে।

আবদুল মোত্তালিবের হাতে যমযম কূপ পুনরাবিষ্কার
কোরাইশ গোত্রের মধ্যে ১৫টি দায়িত্বপূর্ণ পদ ছিল। ঐ সকল দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে কোরাইশরা নিজেদের এবং হাজীদের সেবা করত। এর মধ্যে ‘কাবার সেবক’ এই পদটি সবচাইতে বেশী সম্মানিত ছিল। কাবার সেবকের কাছে কাবার দরজার চাবি থাকতো। তিনি লোকদের জন্য কাবার দরজা খুলতেন এবং বন্ধ করতেন। ২য় গুরুত্বপূর্ণ পদটি ছিল বা পানি পান করানো’। হাজীদের পানি পান করানো খুবই কষ্টসাধ্য ব্যাপার ছিল। কেননা, মক্কায় পানির স্বল্পতার কারণে এই দায়িত্ব পালনকারী বনি হাশেম বিন আবদে মন্নাফ গোত্রকে কাবার পার্শ্বে চামড়ার মশকে পানি জমা করতে হত এবং ঐ সকল পানি মক্কার বাইর থেকে উটের পিঠে করে বহন করে আনা হত। তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ পদটি ছিল হাজীদেরকে খাওয়ানো। কোরাইশরা তাদের ধনী ব্যক্তিদের কাছ থেকে গরীব হাজীদের খানা খাওয়ানোর জন্য অর্থ সংগ্রহ করত এবং ঐ দায়িত্ব পালনকারী ব্যক্তির হাতে তা অর্পণ করত। কুসাই বিন কিলাব নিজে ঐ তিনটি দায়িত্বসহ দারুন নাদওয়াহ পরিচালনা এবং অন্যান্য দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর দুই ছেলে আবদুদ দার এবং আবদে মন্নাফের মধ্যে ঝগড়া-সংঘর্ষের পর তা বন্টন করা হয় ঐ বন্টন অনুযায়ী বনি আবদে মন্নাফ ‘পানি পান করানো’ এবং হাজীদেরকে খানা খাওয়ানোর দায়িত্ব পায়।

অপরদিকে, ‘কাবার সেবা’ এবং দারুন নাদওয়াহর দায়িত্ব অর্পিত হয় বনি আবদুদ্ দারের উপর। পরে হাশেম বিন আবদ মন্নাফের কাছ থেকে তাঁর পুত্র আব্দুল মোত্তালিবের উপর ঐ দায়িত্ব অর্পিত হয়। তারপর আবদুল মোত্তালিব বড় হলে তিনি ঐ পদটি লাভের জন্য নিজ চাচার সাথে ঝগড়া করেন এবং পদটি লাভ করেন । তিনি তাঁর উপর অর্পিত দায়িত্ব এত বেশী যোগ্যতার সাথে পালন করেন যা অতীতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করে। এর ফলে তাঁর সম্মান ও খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। তখন পর্যন্ত যমযম কূপ অনাবিষ্কৃত থাকে। কিন্তু পরে তিনি স্বপ্নে যমযমের অবস্থান সংক্রান্ত লক্ষণের উপর ভিত্তি করে তা খুঁড়ে আবিষ্কার করতে সক্ষম হন । এতে করে তাঁর সুনাম ও যোগ্যতা আরো অনেক বৃদ্ধি পায়। আযরাকী আবদুল মোত্তালিবের যমযম কূপ সংক্রান্ত স্বপ্নটি বর্ণনা করে বলেন, আবদুল মোত্তালিবের বড় ছেলে হারেস বড় হওয়ার পর আবদুল মোত্তালিব রাত্রে স্বপ্নে দেখেন যে কেউ তাকে নির্দেশ দিচ্ছে, ‘কাবার সামনে অবস্থিত মূর্তি বরাবর পিঁপড়ার বসতিতে ময়লা ও রক্তের মাঝে কাকের ঠোঁকরে সৃষ্ট ছিদ্রের মধ্যে খনন করে যমযম কূপ আবিষ্কার কর।’ তিনি মসজিদে হারামে যান এবং স্বপ্নের লক্ষণগুলো দেখার জন্য সেখানে অপেক্ষা করেন। তখন মসজিদে হারামের বাইরে হাযওয়ারা নামক স্থানে একটি গাভী জবেহ করা হয়। গাভীটি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের আগে কসাইর কাছ থেকে ভেগে যমযমের স্থানে এসে পড়তে সক্ষম হয়। পরে কসাই এখানেই গাভীটির জবেহ কাজ সমাপ্ত করে এবং গোশত বহন করে নিয়ে যায়। তখন একটি কাক এসে গাভীর ময়লার উপর বসে এবং পিঁপড়ার বাসা খুঁজে বের করার চেষ্টা করে। এই সকল লক্ষণ দেখার পর আবদুল মোত্তালিব যমযম কূপ খনন শুরু করেন।খনন কাজ দেখে কোরাইশরা আবদুল মোত্তালিবের কাছে ছুটে আসে এবং বলে, আমরা তো আপনাকে মূর্খ মনে করি না কিন্তু আপনি কেন আমাদের মসজিদে হারামের কাছে খনন কাজ করে মসজিদটিকে নষ্ট করছেন? আবদুল মোত্তালিব জবাব দেন, আমি একাজ অব্যাহত রাখবো এবং কেউ আমাকে বাধা দিলে তার মুকাবিলা করবো।

খনন কাজ দেখে কোরাইশরা আবদুল মোত্তালিবের কাছে ছুটে আসে এবং বলে, আমরা তো আপনাকে মূর্খ মনে করি না কিন্তু আপনি কেন আমাদের মসজিদে হারামের কাছে খনন কাজ করে মসজিদটিকে নষ্ট করছেন? আবদুল মোত্তালিব জবাব দেন, আমি একাজ অব্যাহত রাখবো এবং কেউ আমাকে বাধা দিলে তার মুকাবিলা করবো। তিনি তাঁর একমাত্র ছেলে হারেসকে নিয়ে খনন কাজ অব্যাহত রাখায় কোরাইশরা তাঁর সাথে ঝগড়া শুরু করে।কিছু সংখ্যক কোরাইশ তাঁর যোগ্যতা, প্রজ্ঞা ও বংশের প্রতি শ্রদ্ধার কারণে বিরোধীদেরকে বিরত রাখে।

শেষ পর্যন্ত তিনি কূপটি খনন করতে সক্ষম হন। কূপটি খনন করার সময়কার বাধা-বিপত্তি এবং কষ্ট বৃদ্ধি পাওয়ায় তিনি তা সহজ করার জন্য আল্লাহর কাছে মান্নত করেন যে, যদি তার ১০টি ছেলে সন্তান হয় তাহলে তিনি একটিকে আল্লাহর নামে কোরবান করবেন ।  কূপ খননের এক স্তরে তিনি কাবার দাফনকৃত তলোয়ারগুলো দেখতে পান কোরাইশরা তলোয়ার দেখে তাতে নিজেদের অংশ দাবী করে। আবদুল মোত্তালিব বলেন, “এতে তোমাদের কোন অংশ নেই। এগুলো আল্লাহর ঘরের তলোয়ার।” তিনি পানির স্তর পর্যন্ত পৌঁছেন। তিনি কূপকে আরো একটু প্রশস্ত করেন যাতে করে এতে পর্যাপ্ত পানি থাকে এবং না শুকায়।

তিনি কূপের পার্শ্বে পানি সংরক্ষণের জন্য একটি হাউজ নির্মাণ করেন এবং পিতা-পুত্র দু’জনে মিলে সেই হাউজটিতে পানি তুলে ভর্তি করে রাখতেন। হাজীরা সেই হাউজ থেকে পানি পান করত। কিন্তু কোরাইশদের মধ্যে তাঁর প্রতি হিংসা পোষণকারী লোকেরা রাত্রে এসে হাউজটি ভেঙ্গে যেত এবং তিনি প্রতিদিন ভোরে তা পুনঃনির্মাণ করতেন। কোরাইশদের উৎপাত বেড়ে যাওয়ার কারণে তিনি তাদের বিরুদ্ধে আল্লাহর কাছে দোয়া করেন। ফলে, তাঁকে স্বপ্নে দেখানো হয় যে, তুমি বল, “হে আল্লাহ! আমি এর পানি গোসলের জন্য নিষিদ্ধ করছি এবং শুধু পিপাসা নিবারণের জন্য পান করাকে বৈধ ঘোষণা করছি।” আবদুল মোত্তালিব মসজিদে হারামে যান এবং উপস্থিত কোরাইশদেরকে স্বপ্নের কথা শুনান। এর পর থেকে তাঁর তৈরী হাউজ কেউ নষ্ট করতে আসলে শরীরে বিভিন্ন রোগ দেখা দিত । ফলে, তারা তাঁর হাউজ এবং সেখান থেকে পানি পান করা ত্যাগ করে।
এরপর আবদুল মোত্তালিব কয়েকটি বিয়ে করেন এবং ১০টি ছেলে সন্তান লাভ করেন। তিনি আল্লাহর কাছে বলেন, হে আল্লাহ! আমি আমার এক সন্তানকে তোমার উদ্দেশ্যে কোরবানী করার মান্নত করেছিলাম। এখন আমি তাদের মধ্যে লটারী দিয়ে ঠিক করবো যে কাকে কোরবান করবো। তুমি তোমার পছন্দ অনুযায়ী যাকে ইচ্ছা তাকে গ্রহণ কর। লটারীতে তাঁর সর্বাধিক প্রিয় সন্তান আবদুল্লাহর নাম উঠে। তারপর আবদুল মোত্তালিব বলেন, হে আল্লাহ! তুমি আবদুল্লাহ এবং একশত উটের মধ্যে যেটাকে পছন্দ কর সেটাকে গ্রহণ কর। তারপর এর মধ্যে লটারীতে পর্যায়ক্রমে একশত উট উঠায় আবদুল মোত্তালিব ১০০ উট কোরবান করেন।

হযরত আলী (রা) থেকে, তাঁর দাদা আবদুল মোত্তালিবের যমযম কূপ পুনরাবিষ্কার সম্পর্কে বর্ণিত আছে যে, আবদুল মোত্তালিব হিজরে ইসমাঈলে শুয়ে থাকা অবস্থায় স্বপ্নে তিনবার কূপ খননের নির্দেশ পান। তারপর তিনি নিজের একমাত্র ছেলে হারেসকে নিয়ে কূপ খনন করা শুরু করেন এবং কূপে পানির সন্ধান পেয়ে তাকবীর দেন। কোরাইশরা আবদুল মোত্তালিবের সাথে যমযমের কূপের মালিকানা দাবী করে। আবদুল মোত্তালিব নিজ মালিকানার সাথে অন্যদেরকে অংশ দিতে রাজী না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত বনি সাদ বিন হোয়াইম গোত্রের একজন মহিলা গণককে সালিশ মানার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সেই গণক সিরিয়ার নিকট বাস করত। তারা গণকের কাছে রওনা দেয় এবং হেজাজ ও সিরিয়ার মধ্যবর্তী একটি এলাকায় পৌঁছার পর আবদুল মোত্তালিব দলের পানি ফুরিয়ে যায়। ফলে, তারা কঠিন পিপাসার্ত হয়ে পড়ে। অন্য কোরাইশ দল আবদুল মোত্তালিবের দলকে নিজেদের সম্ভাব্য পিপাসার আশংকায় পানি সাহায্য দিতে অস্বীকার করে। পরে দলটির পানিহীন সফরের ভয়াবহ বিপদ সম্পর্কে দলনেতা আবদুল মোত্তালিবের পরামর্শ কামনা করে। আবদুল মোত্তালিব বলেন, পানি ছাড়া আমরা যেহেতু নিশ্চিত মৃত্যুর সম্মুখীন হয়েছি তাই শক্তি থাকতে আমাদের সবাইকে এখন নিজের কবর খুঁড়ে এতে বসে মৃত্যুর অপেক্ষা করা উচিত। সেই অনুযায়ী তাঁর দলের সবাই কবর খুঁড়ে মৃত্যুর অপেক্ষা করতে থাকে। কিন্তু পরে আবদুল মোত্তালিব বললেন, এইভাবে, কবরে পিপাসার মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করা কঠিন ব্যাপার। চল আমরা রওয়ানা দেই হয়ত আল্লাহ আমাদের বাঁচার কোন ব্যবস্থা করে দিতে পারেন । অন্য কোরাইশ দলটি নির্দয়ভাবে আবদুল মোত্তালিবের এই প্রস্থান দৃশ্য অবলোকন করে । ঠিক যে মুহূর্তে তিনি তাঁর উটকে রওয়ানা করাবেন ঠিক সেই মুহূর্তেই উটের পায়ের নীচ থেকে মিষ্টি পানির একটি ফোয়ারা ফুটে উঠে। তারপর আবদুল মোত্তালিব দল খুশীতে তাকবীর ধ্বনি দেয় এবং সওয়ারী থেকে নেমে পানি পান করে ও মশকে পানি ভর্তি করে নেয়। তিনি অন্য কোরাইশ দলটিকেও পানি পান করার আহবান জানিয়ে বলেন, “আল্লাহ আমাদেরকে তাঁর রহমতের করুণা থেকে পানি দিয়েছেন তাই তোমরাও পানি পান কর”।

তারাও পানি পান করে এবং সাথে পানি নিয়ে নেয়। পরে প্রতিদ্বন্দ্বী কোরাইশ দলটি বলে : হে আবদুল মোত্তালিব, আল্লাহর কসম, আমরা আর তোমার সাথে যমযমের বিষয়ে ঝগড়া করবো না। আল্লাহ এ ব্যাপারে তোমার পক্ষে ফয়সালা জানিয়ে দিয়েছেন। চল, আমরা ফিরে যাই। এরপর তারা মক্কায় ফিরে আসে এবং গণকের কাছে যাওয়া বন্ধ করে। ইবনে ইসহাক যমযম কূপ পুনরাবিষ্কার সম্পর্কে হযরত আলী (রা) এর একটি বর্ণনা উল্লেখ করেছেন। সেই বর্ণনায় অতিরিক্ত যে তথ্য যোগ হয়েছে তা হচ্ছে, কৃপ খনন করতে গিয়ে আবদুল মোত্তালিব এতে দাফনকৃত দুটো সোনার হরিণ এবং অস্ত্রশস্ত্র লাভ করনে। কোরাইশরা এই সকল প্রাপ্ত জিনিসে নিজেদের হিসসা দাবী করে। পরে আবদুল মোত্তালিব বলেন, এস আমরা এ ব্যাপারে একটি ইনসাফপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি । তিনি প্রস্তাব করেন যে, এজন্য তীর নিক্ষেপের মাধ্যমে লটারী অনুষ্ঠিত হবে। এতে কাবার জন্য দুটো তীর, আমার জন্য দুটো এবং কোরাইশদের জন্য দুটো তীর থাকবে। কোরাইশরা এই প্রস্তাব মেনে নেয়ায় তিনি কাবার জন্য দুটো হলুদ তীর, নিজের জন্য দুটো কাল তীর এবং কোরাইশদের জন্য দুটো সাদা তীর নির্বাচন করেন এবং কিছু শ্লোক পাঠ করেন। এরপর লটারী অনুষ্ঠিত হয়। হোবল দেবতার সামনে অনুষ্ঠিত ঐ লটারীতে কাবার হলুদ তীর দু’টো হরিণ, আবদুল মোত্তালিবের কাল তীরগুলো তলোয়ার এবং শিল্ড(ঢাল) লাভ করল এবং কোরাইশদের তীর কোন কিছু পেতে ব্যর্থ হল। পরে আবদুল মোত্তালিব তলোয়ার দিয়ে কাবার দরজায় আওয়াজ দেন এবং এতে একটি সোনার হরিণ ঝুলিয়ে রাখেন। কাবার ইতিহাসে এই প্রথম সোনার মাধ্যমে কাবা শরীফ সাজানো হল। তিনি অন্য সোনার হরিণটিকে কাবার অর্থভাণ্ডারে রেখে দেন।

আল্লামা ফাসী বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা)-এর জন্মের পূর্বে আবদুল মোত্তালিব যমযম কূপ খনন করেন । তখন হারেস ব্যতীত তাঁর কোন ছেলে ছিল না। কিন্তু আযরাকী যোহরী থেকে বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা) এর জন্মের পর আবদুল মোত্তালিব যমযম কূপ খনন করেন। তিনি ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণনা করেন যে, আবু তালেব যমযম কূপ পুনঃনির্মাণ করেন এবং বালক মুহাম্মাদ পাথর যোগান দেন। শেষের বর্ণনাটি দুর্বল এবং আগেরটিই বেশী সহীহ। কেননা, নির্ভরযোগ্য বর্ণনা অনুযায়ী সে সময় হারেস ব্যতীত আবদুল মোত্তালিবের অন্য কোন সন্তানাদি ছিল না। আবু তালিব রাসূলুল্লাহকে নিয়ে পরবর্তীতে যমযম কূপের সংস্কার করেছিলেন। এর সাথে আবদুল মোত্তালিবের যমযম কূপ খনন করার কোন সম্পর্ক নেই ।
আবদুল মোত্তালিব তাঁর যমযম খনন করা সংক্রান্ত স্বপ্নকে প্রথমে ভেবেছিলেন যে, এটি হয়তো কোন অশুভ মুর্দার আত্মা কিংবা জিন ও শয়তানের ওয়াসওয়াসা হতে পারে । তিনি এজন্য তা পুরো বিশ্বাস করতে পারেননি। তাই নিজ ছেলে হারেসকে নিয়ে ভয়ে ভয়ে কূপ খনন করতে থাকেন। যদি ঐটি শয়তানের স্বপ্ন হয়ে থাকে তাহলে অন্যরা জানলে তা লজ্জার বিষয় হবে। নচেৎ মক্কার সর্দার হিসেবে যমযম কূপের মত এত মহান কূপের খনন কাজে মক্কার অন্যান্য লোকজনের সহযোগিতার কোন অভাব হওয়ার কথা ছিল না ।

পরিমার্জিত
মূল লেখাঃ মক্কা শরীফের ইতিকথা

Visits: 2

মন্তব্য
Loading...
//shasogna.com/4/4139233