উসমানীয় সাম্রাজের শেষ সূর্যাস্ত

0 ৫৫
১৯৪৪ সালের ২৩ আগস্ট ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে মৃত্যুবরণ করেন। উসমানী শাসকদের সর্বশেষ উত্তরাধিকার খলিফা দ্বিতীয় আব্দুল মজিদ। আনুষ্ঠানিক খিলাফত বিলুপ্তির পূর্বেই তিনি ইস্তাম্বুল ত্যাগে বাধ্য হয়। জীবনের শেষ দিনগুলোয় কষ্ট ও মনোবেদনায় ভুগে নির্বাক হয়ে পড়েছিলেন তিনি। চোখের সামনে তাঁর পূর্বসূরিদের ৬২৪ বছরের কীর্তিময় শাসনের করুণ সমাপ্তি তাঁকে প্রতিনিয়ত দুঃখ-ভারাক্রান্ত করে রাখত।

মৃত্যুর আগে আব্দুল মজিদের শেষ ইচ্ছা ছিল, তাঁর লাশ যেন তুরস্কের তারিবা কবরস্থানে দাফন করা হয়। কারণ, এই কবরস্থানে চিরশয্যায় সমাহিত হয়েছেন তাঁর পিতা সুলতান আব্দুল আজিজ, পিতামহ সুলতান দ্বিতীয় মাহমুদ এবং চাচাতো ভাই সুলতান দ্বিতীয় আব্দুল হামিদ। তুরস্ক থেকে নির্বাসিত হলেও অন্তত মৃত্যুর পর যেন পরিবারের পাশে নিজের জন্মভূমিতে তাঁর শেষ স্থন হয়, এটা ছিল তাঁর জীবনের শেষ চাওয়া।

পিতার মৃত্যু ব্যথিত করে তোলে দুররে শাহওয়ারকে। বাবার শেষ স্বপ্ন পূরণে তিনি ছুটে যান তুরস্কে, অনেক বছর আগে মাত্র ১০ বছর বয়সে তাঁকে এবং তাঁর পরিবারকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল যে জনপদ থেকে। তুরস্কের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইসমত ইতুনুকে দুররে শাহওয়ার অনুরোধ করেন, তাঁর মরহুম পিতা এবং উসমানি সাম্রাজ্যের সর্বশেষ খলিফার লাশ যেন তুরস্কের মাটিতে দাফনের অনুমতি দেওয়া হয়।
তত দিনে অনেক বদলে গেছে তুরস্ক। শাসকদলের সদস্যদের মনে তখনো উসমানি পরিবারের প্রতি ঘৃণা ও বিদ্বেষ জমে আছে। কাজেই খলিফা কন্যার এই আকুতি তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী নির্দয়ভাবে প্রত্যাখ্যান করেন। বিষণ্ণ মনে ফ্রান্সে ফিরে আসেন দুররে শাহওয়ার। পিতার প্রতি গভীর ভালোবাসার শপথ নেন দীর্ঘ প্রতীক্ষার। যে করেই হোক, পূর্বপুরুষের মাটি
তুরস্কে পিতাকে দাফন করার ইচ্ছায় অপেক্ষায় থাকেন সময়ের পালাবদ বাবার স্বপ্নপূরণের প্রত্যাশায় দীর্ঘ ১০ বছর খলিফা আব্দুল মজিদের মৃতদেহ প্যারিসের একটি মসজিদে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেন দুররে শাহওয়ার। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে ক্ষমতার পরিবর্তন ঘটে তুরস্কে।

নতুন প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন ডানপন্থী দলের নেতা আদনান মান্দারিস। খবর পেয়ে দুররে শাহওয়ার আবারও ছোটেন তুরস্কের উদ্দেশে। নতুন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাকে সবিনয় অনুরোধ করেন, তাঁর মরহুম বাবার লাশ যেন তুরস্কের মাটিতে দাফনের অনুমতি দেওয়া হয়। উসমানি পরিবারের এই রাজকন্যার আকুতি শোনেন প্রধানমন্ত্রী। জাতীয় পরিষদের সম্মতি পেলে তিনি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন, আশ্বাস দেন তাঁকে।

তুরস্কের জাতীয় পরিষদে প্রস্তাব তোলা হলো সর্বশেষ উসমানি খলিফা আব্দুল মজিদের লাশ দাফনের। উসমানি পরিবারের প্রতি বিরাগভাজন কয়েকজন সদস্য এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন। ফলে প্রস্তাবটি আর পাস হলো না। আধুনিক তুরস্কের সংকীর্ণতার কাছে আবারও হেরে গেলেন দুররে শাহওয়ার। খেলাফত ব্যবস্থা পতনের পর কয়েক দশক পেরিয়ে যাওয়ার পরও উসমানি পরিবারের এক খলিফার লাশ তুরস্কের মাটিতে দাফনের সুযোগ দেয়নি তুরস্কের জাতীয় পরিষদ ।
ক্ষোভে ও দুঃখে কান্নায় ভেঙে পড়েন দুররে শাহওয়ার। এই অপমান ওলাঞ্ছনা আর পিতার স্বপ্নপূরণে এক দশকের ব্যর্থতা বুকে চেপে শেষবারের মতো তুরস্ক ত্যাগ করেন দূররে শাহওয়ার।
তাঁর এমন করুণ দুঃসময়ে এগিয়ে আসেন সৌদি আরবের বাদশাহ সউদ বিন আব্দুল আজিজ। উসমানি পরিবারের এই মরহুম মুসলিম খলিফার প্রতি সম্মান দেখিয়ে পবিত্র নগরী মদিনার জান্নাতুল বাকিতে তাঁর লাশ দাফনের অনুমতি দেন তিনি। পূর্বপুরুষদের কবরস্থানে জায়গা না পেলেও পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব নবিজির রওজা মুবারকের প্রতিবেশী হয়ে পবিত্র মাটিতে পেলেন মুসলিম জাহানের এই সর্বশেষ উসমানি খলিফা। ১৯৫৪ সালের ৩০ মার্চ তাঁকে দাফন করা হয় জান্নাতুল বাকিতে।
পিতার প্রতি তুরস্কের এই অন্যায় ও প্রতিহিংসামূলক নির্দয় আচরণের প্রতিবাদে পরে সুযোগ পেয়েও আর কোনো দিন তুরস্কের জাতীয়তা ফেরত নেননি দুররে শাহওয়ার। মৃত্যু পর্যন্ত ইংল্যান্ডের জাতীয়তা নিয়ে বেঁচে ছিলেন তিনি।
লন্ডনে থাকাকালে ২০০৬ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি মঙ্গলবার রাতে ৯২ বছর বয়সে পরপারে পাড়ি জমান ইতিহাসের সাক্ষী এই রাজকন্যা। মৃত্যুর আগে দুই পুত্রকে তিনি অসিয়ত করেছিলেন, তাঁর লাশ যেন লন্ডনের এক মুসলিম কবরস্থানে দাফন করা হয়। গুণী ও সংগ্রামী রাজকন্যা পুররে শাহওয়ার ছিলেন চিত্রশিল্পী হওয়ার পশপাশি প্রচণ্ড মেধাবী। পৃথিবীর আটটি ভাষায় কথা বলার দক্ষতা ছিল তাঁর। তাঁর একমাত্র ভাই ওমর ফারুক ১৯৬৯ সালে মৃত্যুবরণ করেন এবং তুরস্কের ইস্তাম্বুলে সমাহিত হন।
ভাবতেই অবাক লাগে, যে উসমানীয় খিলাফতের শাসকরা ৬২৪ বছর তিন মহাদেশ দাঁপিয়ে বেড়িয়েছিলেন তাদের বংশধররাই কিনা মৃত্যুর পর লাশ দাফতের জন্য তুরস্কের ভূখন্ডে সামান্য একটু জায়গা পাননি। জীবনের শেষ মুহুর্তগুলো কিনা অতিবাহিত করে গেছেন অন্যান্য মুসলিম শুভাকাঙ্ক্ষীদের সাহায্য সহযোগিতা নিয়ে….
আজকের আধুনিকতায় বুঁদ হয়ে থাকা ক’জন যুবকই বা জানে তাদের পূর্বপুরুষদের সর্বত্রই বীরত্বের সাথে দাপিয়ে বেড়ানের কথা..? আমার মনে হয় আপনি বাংলাদেশের এমন কোনো যুবক পাবেন না যারা কিনা ঐ ক্লাবের ফ্যান ফলোয়ার না কিংবা ঐ ক্লাব সম্পর্কে জানে না। অথচ ঐ আন্দালুসিয়া যে একদিন আমাদের মুসলিমদের ছিলো কেউ তা জানে..?
ঐ ইস্তানবুল -বাগদাদ -খোরাসান -কারামান-ক্রিমিয়া -গ্রিক – মরক্কো কি ছিলো না আমাদের !! মুসলিম খিলাফত বিলুপ্তির ১০০ বছরে কি আমাদের হৃদয়ে কোনো দাগ কাটে না.?

তথ্যসূত্রঃ 
সুলতান কাহিনি • ১৮১-৮৩

Visits: 0

মন্তব্য
Loading...
//ofglicoron.net/4/4139233