সিন্ধু বিজয়ঃ মুসলিম বাহিনী

0 ৩১

মুসলিম উম্মাহর ইতিহাসে উমাইয়া শাসনামলে জঘন্য ধরনের বিভিন্ন ফিতনা যেমন হয়েছে, তেমনি প্রচুর পরিমাণে শহর বিজয়ও হয়েছে। খেলাফতে রাশেদার পর প্রতিষ্ঠিত উমাইয়া খেলাফত সূচনা থেকে পতন পর্যন্ত অধিকাংশ ইতিহাসবিদের কাছে এক প্রহেলিকাময় চিত্র তৈরি করে রেখেছে। ইতিহাসের পাঠক-গবেষক অধিকাংশের কাছেই উমাইয়া খেলাফত পদস্খলনের জায়গা। এই অন্ধকার আরও বাড়িয়েছে উমাইয়া শাসনামলে সংঘটিত মুসলিমদের অনুভূতি নাড়িয়ে দেওয়া বড় দুর্ঘটনাগুলো। কারবালার দুর্ঘটনা, মক্কা-মদিনায় হামলা। এগুলো উমাইয়াদের সুখ্যাতি ছাপিয়ে নেতিবাচক ইমেজ তৈরি করেছে। এসব কারণে উমাইয়াদের সম্পর্কে ক্ষমতালিপ্সার একটা অভিযোগ উঠে থাকে।

তবে উমাইয়ারা বস্তুগত, রাজনৈতিক ও সামাজিক এমন কিছু কীর্তি রেখে গেছে, যা তাদের সম্পর্কে নিছক ক্ষমতালিপ্সার অভিযোগ নাকচ করে দেয়। তাওহিদ ও জিহাদের পতাকা সমুন্নত করার ক্ষেত্রে তারা বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। তারা যে-বিজয় নিয়ে এসেছে, যে-মর্যাদাসৌধ তারা নির্মাণ করেছে—পৃথিবীর দিকে-দিকে ইসলাম প্রচারের ক্ষেত্রে তা বড় ধরনের অবদান রেখেছে।

এই বিজয় আরও বেগবান হয় উমাইয়া খলিফা আব্দুল মালিক ইবনে মারওয়ানের (৬৫-৮৬ হি.) সময় থেকে। একদিকে মুসা বিন নুসাইর, তাঁর অধীনে তারিক বিন যিয়াদ, আরেকদিকে কুতাইবা বিন মুসলিম, অপরদিকে আব্বাস ইবনুল ওয়ালিদ, আরেকদিকে মাসলামা, অন্যদিকে মুহাম্মাদ বিন কাসিম। একেকজন কুশলী সমরবিদ। ৮০ থেকে ১০০ হিজরি পর্যন্ত সময়টাতে বিজয়ের প্রবল এক জোয়ার এসেছিল মুসলিম বিশ্বে। সেই জোয়ারে ৯২ হিজরিতে পুরোদমে দৃশ্যপটে আসেন সিন্ধুবিজেতা মুহাম্মাদ বিন কাসিম। অন্য মহান মুজাহিদদের মতো মুহাম্মাদ বিন কাসিমকে প্রেরণের পিছনের কারিগরও ছিলেন সবচেয়ে নিন্দিত-নন্দিত গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ। বেপরোয়া, একরোখা এবং বহু আলিম ও মুসলমানের রক্তে রঞ্জিত হাতের উদ্ধত অধিকারী এই হাজ্জাজ কুতাইবা বিন মুসলিম ও মুহাম্মাদ বিন কাসিম সহ বেশ কয়েকজন মুসলিম মুজাহিদ সেনাপতির নিয়োগদাতা।

মুহাম্মাদ বিন কাসিম আমাদের এই অঞ্চলের জন্য একটু বেশিই প্রাসঙ্গিক। কারণ, আমাদের কাছে ইসলাম পৌঁছার ক্ষেত্রে মুহাম্মাদ বিন কাসিম রহ.-এর বিজয়গুলোর বিশেষ ভূমিকা আছে। সিন্ধ ও হিন্দে অভিযানের সূচনা উমর রাযিয়াল্লাহু আনহুর সময়ে হলেও ব্যাপক বিজয় মুহাম্মাদ বিন কাসিমের হাত ধরে আসে। এবং সেই সাথে ইসলামের প্রচারও হয়। এবার মূল প্রসঙ্গে প্রবেশ করা যাক।

মুহাম্মাদ বিন কাসিম ছিলেন সাকিফ গোত্রের লোক। সাকিফ গোত্রের লোকজন শাসনকার্যের বিভিন্ন পদের সাথে সংশ্লিষ্ট ছিল বেশি। মুহাম্মাদ বিন কাসিমের বাবা কাসিম বিন মুহাম্মাদ ছিলেন হাজ্জাজ নিযুক্ত বসরার আমির। ফলে উমাইয়া বংশের হওয়ার কারণে পারিবারিকভাবেই শাসনকার্যের সাথে সংশ্লিষ্টতা দেখে বড় হয়েছেন। (১)

তাই ধরে নেওয়া যায়, আরবের জরুরি বিদ্যা যুদ্ধবিদ্যাও শিখেছেন নিয়মমতো প্রথম বয়সেই। মুসলিম ইতিহাসের একটা উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হলো—বড়-বড় সেনাপতি ও বিজেতাদের ব্যক্তিগত ইতিহাস খুব বেশি পাওয়া যায় না। বিজয়, নিয়োগ, বরখাস্ত এবং মৃত্যু—মৌলিকভাবে এগুলোই শুধু সামনে আসে। মুহাম্মাদ বিন কাসিমও এর ব্যতিক্রম নন। তাই শৈশবের কথা বাদ দিয়ে মুহাম্মাদ বিন কাসিমের সাথে সিন্ধের যুদ্ধের ময়দানে প্রবেশ করি।

তার আগে একটি সংশয় নিরসন করা যাক। হাজ্জাজ বিন ইউসুফ কি আসলেই মুহাম্মাদ বিন কাসিমের চাচা? নসিম হিজাযির উপন্যাস পড়ে মুহাম্মাদ বিন কাসিমকে চেনার ফলে এমন একটা ধারণা প্রচলিত আছে। বিষয়টা একটু খতিয়ে দেখা যাক।

এই প্রশ্নের সমাধানের জন্য প্রথমেই দুজনের বংশধারা দেখা যাক। মুহাম্মাদ বিন কাসিমের পুরো নাম হলো—মুহাম্মাদ বিন কাসিম বিন মুহাম্মাদ বিন হাকাম বিন আবি আকিল। আর হাজ্জাজ বিন ইউসুফের পুরো নাম হলো—হাজ্জাজ বিন ইউসুফ বিন হাকাম বিন আবি আকিল। (২)

তাহলে দেখা যাচ্ছে—হাজ্জাজের বাবা হলেন ইউসুফ এবং মুহাম্মাদের পিতা কাসিমের বাবা হলেন মুহাম্মাদ। অর্থাৎ, দুজন ভাই নন। তবে ইউসুফ এবং মুহাম্মাদের পিতা হলেন হাকাম ইবনে আবি আকিল। অর্থা, হাজ্জাজ এবং কাসিমের পিতা পরস্পর ভাই-ভাই। তাহলে যা দাঁড়াচ্ছে তা হলো—হাজ্জাজ এবং কাসিম পরস্পর ভাই নন, বরং তাদের পিতা পরস্পর ভাই। আর কাসিম ও হাজ্জাজ হলেন পরস্পর চাচাতো ভাই। সুতরাং মুহাম্মাদ বিন কাসিম হাজ্জাজ বিন ইউসুফের ভাতিজা নন; বরং তারা একই বংশের লোক।

উপমহাদেশীয় হিসেবে একে চাচাতো চাচা বলা গেলেও আরবের পরিবারব্যবস্থায় চাচাতো চাচাকে কখনোই চাচা বলা হয় না। নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে উমর রাযিয়াল্লাহু আনহুকে বলেছিলেন—“উমর, জানো না চাচা বাবার সমতুল্য”?—সেখানেও চাচার কথাই বলা হয়েছে, চাচাতো চাচা নয়। (৩)

দ্বিতীয় কথা হলো—ইতিহাসের গ্রহণযোগ্য কোনো মাসাদিরেও হাজ্জাজকে মুহাম্মাদ বিন কাসিমের চাচা বলা হয়নি। সুতরাং হাজ্জাজ মুহাম্মাদ বিন কাসিমের চাচা ছিলেন—এই কথা ঠিক নয়।

সিন্ধে হামলাকারী ব্যক্তি মুহাম্মাদ বিন কাসিমই প্রথম নন। বরং তার বহু আগে থেকেই সিন্ধে হামলা হয়ে আসছে।
সিন্ধে তাঁর পূর্বে যারা হামলা করেছেন :
ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর রাযিয়াল্লাহু আনহুর বাহরাইন ও ওমানের আমির উসমান ইবনে আবিল আস সাকাফি তার ভাই মুগিরা ইবনে আবিল আসকে দেবল সাগরে অভিযানে পাঠান। তিনি সেখানে শত্রুদের সাথে লড়াই করে বিজয় লাভ করেন। এই ঘটনা ১৫ হিজরির পরের কথা। উসমান রাযিয়াল্লাহু আনহুর শাসনামলে তার নির্দেশে হাকিম ইবনে জাবালা হিন্দের সীমান্ত অঞ্চলে যুদ্ধের উদ্দেশ্যে রেকি করে যান। কিন্তু অভিযান হয়নি।

৩৮ হিজরির শেষ বা ৩৯ হিজরির শুরুতে হারিস বিন মুররাহ সিন্ধের সীমান্তে হামলা করে বিজয় লাভ করেন। কিন্তু পরে খোরাসান সংলগ্ন কীকান অঞ্চলে তাকে এবং তার সাথীদেরকে হত্যা করা হয়। মুহাল্লাব বিন সুফরা দ্বিতীয়বার সীমান্ত অঞ্চলে হামলা করেন। তিনি মুলতান ও কাবুলের মধ্যবর্তী পান্না ও আহওয়ার পর্যন্ত পৌঁছে যান।

হযরত মুয়াবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহুর শাসনামলে আব্দুল্লাহ ইবনে সাওয়ার সে অঞ্চলের শাসক নিযুক্ত হন। এবং কীকানে হামলা করে বিজয় লাভ করেন। মুয়াবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহুর শাসনামলেই যিয়াদ ইবনে সালামাহ হুযালি মাকরান জয় করেন। (৪)

এরপরেও হিন্দ ও সিন্ধে মুসলমানদের আক্রমণ অব্যাহত ছিল। ইতিহাসে আরও হামলার কথা পাওয়া যায়। মোটকথা, মুহাম্মদ বিন কাসিম হিন্দুস্তানের প্রথম বিজেতা নন। বরং এই সিলসিলা ওমর রাযিয়াল্লাহু আনহুর শাসনামলে শুরু হয়। যা পূর্ণতা পায় মুহাম্মদ বিন কাসিমের হাত ধরে।

মুহাম্মদ বিন কাসিমের হিন্দুস্তান অভিযান এবং এর কারণ মুসলিম বিশ্বে তখন উমাইয়া খেলাফত চলছে। খলিফার পদ ধারণ করেছেন ওয়ালিদ বিন আব্দুল মালিক। ইরাকে ওয়ালিদের নিযুক্ত গভর্নর হলেন হাজ্জাজ-বিন-ইউসুফ। পৃথিবীর দিকে দিকে মুসলিমদের বিজয় চলছে।মুহাম্মদ বিন কাসিম প্রথমে ছিলেন পারস্যের আমির। সেখানে কুর্দিদেরকে শায়েস্তা করার জন্য হাজ্জাজ-বিন-ইউসুফ তাকে নিযুক্ত করেন। এটি ৮৩ হিজরির ঘটনা। (৫)

সিন্ধের সীমান্ত ও বিজিত অঞ্চলে হাজ্জাজ-নিযুক্ত শাসক তখন মুহাম্মাদ বিন হারুন। জাযিরাতুল ইয়াকুতের রাজা হাজ্জাজের সাথে সম্পর্ক বৃদ্ধির জন্য সেখানকার পিতৃহীন কিছু মুসলিম কন্যাকে জাহাজে করে উপঢৌকন পাঠায়। পথিমধ্যে দেবলের কিছু জলদস্যু জাহাজে আক্রমণ করে সব ছিনিয়ে নেয়। তখন এক মুসলিম কন্যা “হে হাজ্জাজ” বলে ডাক দেয়।

হাজ্জাজের কানে এই খবর পৌঁছলে তার মধ্যে দ্বীনী চেতনা জেগে ওঠে। রাজা দাহিরের কাছে বন্দীদের ফেরত চেয়ে হাজ্জাজ দূত পাঠান। কিন্তু রাজা দাহির ধৃষ্টতা দেখিয়ে বলে, তাদেরকে বন্দি করেছে জলদস্যুরা। এখানে আমি কিছু করতে পারব না। হাজ্জাজ এতে প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হন।

মুহাম্মদ বিন কাসিম তখন পারস্যে। হাজ্জাজ পত্র মারফত মুহাম্মদ বিন কাসিমকে সিন্ধু অভিযানের প্রস্তুতি নিতে বলেন। সিন্ধুর পূর্বের আমিরকে সরিয়ে মুহাম্মদ বিন কাসিমকে নিযুক্ত করা হয় সেখানকার আমির ও সেনাপতি।
মুহাম্মদ বিন কাসিম নির্দেশ পেয়ে পূর্ণ প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। শামের ছয় হাজার লোকের একটি সেনাদল তার বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত করেন। আরও অন্যান্য সেনা অন্তর্ভুক্ত করেন। যুদ্ধের জন্য প্রয়োজনীয় সকল সরঞ্জাম জমা করেন। এক্ষেত্রে মুহাম্মাদ বিন কাসিম কোনো ধরনের ত্রুটি করেননি। এমনকি সামান্য সুঁই এবং সুতোও প্রস্তুতিতে অন্তর্ভুক্ত করতে বাদ রাখেননি। এ থেকে মুহাম্মদ বিন কাসিমের প্রস্তুতির ক্ষেত্রে সতর্কতার ব্যাপারটি আঁচ করা যায়। হাজ্জাজ নির্দেশ দেন শিরাজে গিয়ে কিছুদিন অবস্থান করতে; লোকজন এবং প্রস্তুতি—কোনোকিছুতে যেন ঘাটতি না থাকে। প্রস্তুতি সম্পন্ন হলে মুহাম্মদ বিন কাসিম সিন্ধের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন। (৬)

সময়টা ৯২ হিজরি। মাকরান পূর্ব থেকেই মুসলমানদের অধীনে। মুহাম্মাদ বিন কাসিম তার বাহিনী নিয়ে গিয়ে উঠলেন মাকরানে। বিশ্রামের জন্য সময় নিলেন কয়েকদিন। চূড়ান্ত যুদ্ধের আগে শীতল প্রস্তুতি। (৭)

সফরের ধকল কাটিয়ে উঠতেই রওনা হলেন কন্নৌজপুরের উদ্দেশ্যে। যুদ্ধের মাধ্যমে জয় করলেন কন্নৌজপুর। তারপর রওনা হলেন আরমাইলের দিকে। আরমাইলবাসী যুদ্ধের বদলে বেছে নিল সন্ধির পথ। মুহাম্মাদ বিন কাসিমের হাতে বিজিত হলো পরপর দুটি শহর। (৮)
পূর্বের আমির মুহাম্মদ বিন হারুনও যোগ দেন মূল বাহিনীর সাথে। কিন্তু আরমাইলের কাছাকাছি পৌঁছতেই তিনি ইন্তেকাল করেন। (৯)

সেখানেই তাকে দাফন করা হয়। মুহাম্মদ বিন কাসিম যে-বছর বিজয় অভিযান শুরু করেছেন তখনকার বিশ্বের অবস্থা দেখা যাক। পারস্য ইতিমধ্যে মুসলমানদের পদানত হয়েছে। বিন কাসিম পারস্য থেকেই এসেছেন। রোমের বাতি নিভুনিভু করছে। একের পর এক মুসলিম সেনাপতিরা হামলা করে যাচ্ছেন। মাসলামা ইবনে আব্দুল মালিক এবং ওমর ইবনুল ওয়ালিদ হামলা করেছেন রোমের ভিতর। মাসলামার হাতে রোমকদের তিনটি দুর্গের পতন ঘটেছে। সুসানার লোকেরা রোমের আরো ভিতরে চলে গেছে।

অন্যদিকে মুসা বিন নুসাইর তার আযাদকৃত গোলাম তারিক বিন জিয়াদকে মাত্র ১২ হাজার সৈন্য দিয়ে পাঠিয়েছেন আন্দালুসে। দুঃসাহসী মুজাহিদ তারিক বিন জিয়াদ তুমুল রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর হত্যা করেছেন আন্দালুসের রাজা অ্যাড্রিনোককে। জয় করেছেন আন্দালুস। (১০)

মহান মুজাহিদরা যখন জানবাজি রেখে ইসলামের পতাকা উড্ডীন করে চলেছেন, তখন আরেকদল মানুষ কুরআনের “ফালাওলা নাফারা”র নির্দেশ মেনে বসে আছেন দরসের হালকায়। কারণ, দেশ বিজয়ের দায়িত্ব খলিফা ও সেনাপতিদের হলেও সেসব অঞ্চলে ইসলামের বিশুদ্ধ ইলম পৌঁছে দেওয়া আলিমদের দায়িত্ব।

দারুল ইসলামে বসে চলছে আমের ইবনে শারাহিল শা’বির দরসের হালকা। দরসে চুপচাপ বসে আমের শা’বির জ্ঞানগর্ভ ইলমী আলোচনা শুনছেন তারা। সেখানে বসে আছেন মাকহুল শামি, ইবনে আবি লাইলা, আতা ইবনুস সাইব এবং ইবনে আউন। (১১)

মুহাম্মদ ইবনে সিরিনের দরসে বসে আছেন কাতাদা, সাঈদ ইবনে আবি আরুবা এবং মাহদি ইবনে মাইমুন। (১২) কিন্তু সবাইকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে চলে গেলেন শা’বি, ইবনে সিরিন এবং যুহরির উস্তাদ সাহাবী আনাস ইবনে মালেক রাযিয়াল্লাহু আনহু। (১৩) ভারাক্রান্ত মনে সে বছরের হজ আদায় করলেন মদিনার গভর্নর ওমর ইবনে আব্দুল আজিজ। (১৪)

মুহাম্মাদ বিন কাসিম তার বিজয়যাত্রা অব্যাহত রাখলেন। আরমাইল থেকে রওয়ানা হলেন দেবলের উদ্দেশ্যে। দেবল, যে-মাটিতে বন্দি আছে মুসলিম বোনেরা। মুহাম্মদ বিন কাসিম যেদিন দেবল পৌঁছলেন সেদিন ছিল শুক্রবার। চূড়ান্ত আক্রমণ হানতে হবে দেবলে। জনবল, অস্ত্রশস্ত্র এবং রসদ ভর্তি জাহাজগুলো ঘাটে নোঙর করল। মুহাম্মদ বিন কাসিম চূড়ান্ত লড়াইয়ের জন্য কৌশলী যুদ্ধপন্থা অবলম্বন করলেন। যে-যুদ্ধকৌশল অবলম্বন করেছিলেন আরেক মুহাম্মদ, প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, ইয়াওমুল আহযাবে।

দেবলে অবস্থানস্থলের চারপাশে মুহাম্মদ বিন কাসিম খন্দক খনন করলেন। খন্দক ভরে দিলেন বর্শা দিয়ে। বিভিন্ন দিকে পতাকা ছড়িয়ে দিয়ে সবাইকে পতাকাতলে সমবেত করে দিলেন। ৫০০ লোকে টানা মিনজানিক স্থাপন করলেন। মিনজানিকটির নাম আরুস—বর। মুহাম্মদ বিন কাসিম কতটা কৌশলী সমরবিদ ছিলেন, দেবল অভিযান তার বড় প্রমাণ।

দেবলে একটি বড় বৌদ্ধ মূর্তি ছিল। দেবলের উপাস্য। মূর্তিটি ছিল বড় একটি মিনারের উপর। তার ওপর পরিত্যক্ত জাহাজের একটি লম্বা মাস্তুল। মাস্তুলের মাথায় বাঁধা ছিল একটি লাল পতাকা। বাতাস বইলে শহরকে কেন্দ্র করে পতপত করে উড়তে থাকত লাল পতাকাটি।

প্রতি তিনদিন অন্তর-অন্তর মুহাম্মদ বিন কাসিম হাজ্জাজকে পত্র মারফত অগ্রগতির খবর জানাচ্ছিলেন। দেবলে অবস্থান করে বিস্তারিত বিবরণ সহ প্রস্তুতির খবর হাজ্জাজকে জানান। ফিরতি পত্রে হাজ্জাজ-বিন-ইউসুফ নির্দেশ দিলেন, মূর্তিটিকে লক্ষ্য করে মিনজানিক থেকে পাথর নিক্ষেপ করো। ফলাফল পাবে। বেশ কিছুদিন অবরোধের পর একদিন মিনজানিক থেকে পাথর ছোড়েন মূর্তিটিকে লক্ষ্য করে। মিনজানিকের আঘাতে পতাকাসমেত মাস্তুলটি ভেঙে পড়ে। বৌদ্ধ মূর্তির সাথে সাথে শহরবাসীর মনোবলও ভেঙে পড়ে।

শহরপ্রাচীরে থাকা বৌদ্ধ মূর্তির ওপর মিনজানিক ব্যবহারের মধ্য দিয়ে যুদ্ধ শুরু হয়। মুহাম্মদ বিন কাসিম শহরে আক্রমণ করে তাদেরকে পরাজিত করেন। রাজা দাহির পালিয়ে যায়। মুহাম্মাদ বিন কাসিম তিনদিন সেখানে অবস্থান করে দাহিরের লোকদেরকে হত্যা করেন। হত্যা করেন উপাসনালয়ের রক্ষীদেরকে। তারপর মুসলমানদের জন্য সেখানে মসজিদ নির্মাণ করে মুহাম্মদ বিন কাসিম বিরুনের দিকে রওনা হন। (১৫) পথিমধ্যে হাজ্জাজের পত্র আসে—“যতটুকু অঞ্চল বিজয় করেছ, তার সবটার আমির তুমি”। হিজরি ক্যালেন্ডারে সময়টা তখন ৯৩ হিজরি। (১৬)

মুহাম্মদ বিন কাসিম সিন্ধু অঞ্চলে যতগুলো যুদ্ধ করেছেন, তারমধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ ধরা হয় রাজা দাহিরের বিরুদ্ধে এই যুদ্ধটিকে। কারণ, দাহির ছিল সিন্ধের প্রতাপশালী রাজা। দাহিরকে হত্যার মাধ্যমে দুটি বিষয় প্রমাণিত হয়। প্রথমত, মুসলমানদেরকে দুর্বল মনে করা হয়েছিল, তার যথোচিত জবাব দেওয়া হয়। দ্বিতীয়ত, হিন্দু রাজাদের সাহসিকতায় চিড় ধরে। যার ফলে মুহাম্মদ বিন কাসিম পরবর্তীতে বেশকিছু শহর যুদ্ধ ছাড়া কেবল সন্ধির মাধ্যমে বিজয় করেছেন। হিন্দু রাজারা বুঝতে পেরেছিল, জানবাজ মুসলিম মুজাহিদদের সামনে তাদের টিকে থাকা সম্ভব নয়। এ যুদ্ধের পর মুহাম্মদ বিন কাসিম প্রায় সম্পূর্ণ সিন্ধু অঞ্চল বিজয় করেন।

দেবল যুদ্ধের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিয়েছেন মুহাম্মদ বিন কাসিমের বাহিনীতে থাকা যোদ্ধা কাহমাস বিন হাসান। কাহমাস বলেন, “আমি মুহাম্মদ বিন কাসিমের বাহিনীতে ছিলাম। রাজা দাহির এক বিরাট সৈন্যদল নিয়ে আমাদের মুখোমুখি হয়। তার সাথে ছিল ২৭টি হাতি। আমরা তাদের পেরিয়ে শহরে ঢুকে পড়ি। আল্লাহ তা’আলা তাদেরকে পরাজিত করে দেন। দাহির তখন পালিয়ে যায়। কয়েকজন মুসলমান সেনা শত্রুদেরকে পশ্চাদ্ধাবন করে হত্যা করেন। তারপর মুসলিম শিবিরে ফিরে আসেন। পরবর্তীতে অন্য এক শহর থেকে ফেরার সময় রাতের বেলা রাজা দাহির বিশাল বাহিনী নিয়ে উন্মুক্ত তরবারী হাতে এসে উপস্থিত হয়। সেখানে রাজা দাহির এবং তার সঙ্গীরা নিহত হয়। বাহিনীর অন্য সৈন্যরাও পরাজয় বরণ করে।

মুহাম্মদ বিন কাসিম তাদেরকে ধাওয়া করে ব্রহ্মা শহর পর্যন্ত চলে আসেন। ব্রহ্মা শহরের লোকেরা শহর থেকে বেরিয়ে এসে লড়াই করে। কিন্তু মুসলমানদের আক্রমণের তীব্রতার সামনে টিকতে না পেরে তারা পুনরায় শহরে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। তারপর মুহাম্মদ বিন কাসিম শহর অবরোধ করেন এবং শহরের পতন ঘটে। বিন কাসিম সেখান থেকে যান কিরজে। কিরজও জয় করেন”। (১৭)

সবগুলো ঘটনাই ঘটেছে ৯৩ হিজরিতে। যখন অন্যদিকে কুতাইবা বিন মুসলিম হামলা করেছেন খাওয়ারিজম এবং সমরকন্দে। আব্বাস ইবনুল ওয়ালিদ হামলা করে বিজয় করেছেন রোমের একটি দুর্গ। মারওয়ান ইবনুল ওয়ালিদ ঢুকে গেছেন রোমের খানজারায়। মাসলামা জয় করেছেন তুরস্কের মালাতিয়ার নতুন দুর্গের উভয় প্রবেশদ্বার। মুসা বিন নুসাইর জলস্থল পেরিয়ে ছুটে চলেছেন পশ্চিমের পানে। (১৮)

এরপর মুহাম্মদ বিন কাসিম আরও অনেক শহর জয় করেছেন। পরাজিত করেছেন অসংখ্য মুশরিক রাজাদেরকে। ১৪ হিজরিতে সাসসা এবং ৯৫ হিজরিতে মুলতান বিজয় করেন। এর মধ্যে ৯৫ হিজরিতে হাজ্জাজ এবং ৯৬ হিজরিতে ওয়ালিদ মারা গেলে দৃশ্যপট বদলে যেতে শুরু করে। দাহির মারা যাওয়ার পর মুহাম্মদ বিন কাসিম সিন্ধের প্রায় সবগুলো শহর জয় করে নেন। তার জয়যাত্রা রাউর পর্যন্ত পৌঁছে যায়। রাউর জয় করেন যুদ্ধ করে। অনেক শহর সন্ধির মাধ্যমে মুহাম্মদ বিন কাসিমকে বরণ করে নেয়।

এই সময়ে ব্যাপকভাবে যেটা হয়েছিল সেটা হলো—প্রতিটি শহরেই বেশকিছু মুসলমান বাসিন্দা থেকে যেতেন। এর মধ্যে স্থানীয় অনেক হিন্দুও মুসলমান হয়। আরব থেকে আসা মুসলমানরা তখন তাদেরকে দ্বীনের দীক্ষা দেওয়ার কাজটি করতেন।

সিন্ধু অভিযানের সময় মুহাম্মাদ বিন কাসিমের বয়স কত ছিল?
ইতিহাসগ্রন্থগুলোতে মুহাম্মাদ বিন কাসিমের বয়স নিয়ে প্রসিদ্ধ যে বর্ণনাটি পাওয়া যায় তা হলো—তখন তাঁর বয়স ছিল ১৭ বা ১৮ বছর। এই বর্ণনাটি প্রসিদ্ধ হলেও সঠিক নয়। একথা স্বীকৃত যে, ৮৩ হিজরিতে মুহাম্মদ বিন কাসিম পারস্যের আমির নিযুক্ত হয়েছিলেন। তৃতীয় হিজরি শতাব্দীর ইতিহাসবিদ খলিফা ইবনে খাইয়াত যেমন এই কথা বলেছেন, অষ্টম শতাব্দীর ইতিহাসবিদ যাহাবিও সেকথা স্বীকার করেছেন। অর্থাৎ পারস্যে তাঁর আমির নিযুক্ত হওয়ার ঘটনাটি সিন্ধে হামলা করার ঠিক দশ বছর আগের কথা। তার মানে মুহাম্মদ বিন কাসিমের বয়স তখন সাত কিংবা আট। যেটা ঐতিহাসিক এবং বাস্তবিক উভয়ভাবেই অসম্ভব। বরং এক্ষেত্রে বিশুদ্ধ তথ্য হলো—সিন্ধে হামলার সময় তাঁর বয়স আরও বেশি ছিল। কাজি আতহার মুবারকপুরী রহ. প্রমাণ করেছেন তার বয়স ছিল ২৮ বছর।

মুহাম্মদ বিন কাসিমের এই বিজয়যাত্রার পিছনে ছিল তাঁর ইমানি চেতনা। যার কারণে তিনি খেলাফতের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবাদ করেননি। তাঁর হাতে তখন যে-পরিমাণ বিজিত অর্থসম্পদ এবং সেনাবাহিনী ছিল, চাইলেই খেলাফতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে সিন্ধে তাঁর নিজস্ব সাম্রাজ্য কায়েম করতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। কারণ, মুহাম্মাদ বিন কাসিম সম্পদ কিংবা ক্ষমতার লোভে যুদ্ধ করেননি। যুদ্ধ করেছেন ইমানি চেতনা নিয়ে। কাফিরদেরকে দমন করার উদ্দেশ্যে।

মুহাম্মাদ বিন কাসিমের বিজয়যাত্রা যখন অব্যাহতভাবে চলছে, এমন সময় ৯৬ হিজরিতে খলিফা ওয়ালিদ বিন আব্দুল মালিক ইন্তেকাল করেন। খিলাফতের মসনদে বসেন ওয়ালিদের ভাই সুলাইমান বিন আব্দুল মালিক। কিন্তু সুলাইমান মুহাম্মাদ বিন কাসিমকে বরখাস্ত করেন। সিন্ধের আমির নিযুক্ত করেন ইয়াজিদ ইবনে আবি কাবশা সাকসাকিকে। মুয়াবিয়া ইবনে মুহাল্লাবের সাথে মুহাম্মদ বিন কাসিমকে বন্দি করে নিয়ে যাওয়া হয় ইরাকে।

ইতিপূর্বে মুহাম্মদ বিন কাসিমের বংশের গভর্নর হাজ্জাজ-বিন-ইউসুফ ইরাকের খারাজ-কর্মকর্তা সালেহের ভাই আদমকে হত্যা করেছিল। সেই সূত্র ধরে সালেহ কারাগারে আবু আকিল গোত্রের লোকদেরকে চরম নির্যাতন করে। সেই নির্যাতনের দরুণ মুহাম্মদ বিন কাসিম ইন্তেকাল করেন। মুহাম্মদ বিন কাসিমের দোষ ছিল তিনি আবু আকিল গোত্রের, যে-গোত্রের হাজ্জাজ সালেহের ভাই আদমকে হত্যা করেছিল। (১৯)

মুহাম্মাদ বিন কাসিমের পর সেই অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকলেও সেটা আর গতি লাভ করেনি। বিভিন্ন অঞ্চলের পালিয়ে যাওয়া হিন্দু রাজারা মুহাম্মাদ বিন কাসিমের প্রস্থানের সংবাদ শুনে নিজ-নিজ রাজ্যে ফিরে আসে। কিন্তু, উপমহাদেশের প্রেক্ষাপটে মুহাম্মাদ বিন কাসিমের মতো মহান মুজাহিদ আর আসেননি। যতদিন ভারত উপমহাদেশে ইসলাম থাকবে, ততদিন মানুষ মুহাম্মাদ বিন কাসিমকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে। আল্লাহ তাআলা তাঁর তুরবতকে শীতল রাখুন, আমিন।

সূত্রসমূহ :
(১) জামহারাতু আনসাবিল আরব, পৃ. ২৬৭-২৬৮, ইবনে হাযম আন্দালুসি, দারুল মাআরিফ, পঞ্চম সংস্করণ
(২) প্রাগুক্ত
(৩) সহিহ মুসলিম, হাদিস নং-৯৮৩
(৪) ফুতুহুল বুলদান, পৃ. ৬০৭-৬০৯, বালাজুরি, মুয়াসসাসাতুল মাআরিফ, ১৪০৭ হি.
(৫) তারিখু খলিফা ইবনে খাইয়াত, পৃ. ২৮৮, দার তাইবা, দ্বিতীয় সংস্করণ, ১৪০৫; তারিখুল ইসলাম ৬/১৮, যাহাবি, দারুল কিতাবিল আরাবি, প্রথম সংস্করণ, ১৪১১ হি.
(৬) ফুতুহুল বুলদান, পৃ. ৬১১-৬১২, বালাজুরি, মুয়াসসাসাতুল মাআরিফ, ১৪০৭ হি.
(৭) ফুতুহুল বুলদান, পৃ. ৬১৩, বালাজুরি
(৮) তারিখু খলিফা ইবনে খাইয়াত, পৃ. ৩০৪; তারিখুল ইসলাম ৬/২৫৪, যাহাবি
(৯) ফুতুহুল বুলদান, পৃ. ৬১৩, বালাজুরি
(১০) তারিখুত তাবারি, ৬/৪৬৮, দারুল মাআরিফ মিসর, দ্বিতীয় সংস্করণ; আল-মুন্তাযাম ফি তারিখিল মুলুকি ওয়াল উমাম, ৬/৩০৩, ইবনুল জাওযি, দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ, দ্বিতীয় সংস্করণ
(১১) সিয়ারু আ’লামিন নুবালা, ৪/২৯৭, যাহাবি, মুয়াসসাসাতুর রিসালাহ, তৃতীয় সংস্করণ, ১৪০৫ হি.
(১২) সিয়ারু আ’লামিন নুবালা, ৪/৬০৭
(১৩) আল-মুন্তাযাম, ৬/৩০৪, ইবনুল জাওযি
(১৪) তারিখুত তাবারি, ৬/৪৬৮
(১৫) ফুতুহুল বুলদান, পৃ. ৬১৩-৬১৪, বালাজুরি
(১৬) তারিখু খলিফা ইবনে খাইয়াত, পৃ. ৩০৪
(১৭) তারিখু খলিফা ইবনে খাইয়াত, পৃ. ৩০৪-৩০৫
(১৮) প্রাগুক্ত
(১৯) ফুতুহুল বুলদান, পৃ. ৬১৮-৬১৯, বালাজুরি

[লেখাটি ফাতেহ ঈদসংখ্যা-২০২০ এ প্রকাশিত]

Visits: 0

মন্তব্য
Loading...
//thirsoab.com/4/4139233