গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড

সদক-ই-আজম বা শের শাহ সড়ক

0 ৭২

গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড এশিয়ার অন্যতম প্রাচীন ও দীর্ঘতম সড়ক পথ। এটি মধ্য এশিয়াকে ভারতীয় উপমহাদেশের সাথে সংযুক্ত করেছে। এটি বাংলাদেশের মায়ানমার সীমান্তে টেকনাফ হতে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও ঢাকা, কলকাতা, কানপুর, দিল্লি, ভারতের অমৃতসর হয়ে পশ্চিমে পাকিস্তানের লাহোর, গুজরাট, রাওয়ালপিন্ডি এবং পেশোয়ার কাবুল, আফগানিস্তান পর্যন্ত পৌছায়।

সুর সম্রাজ্যের মধ্যযুগীয় শাসক শের শাহ সুরি ১৬ শতকে রাস্তাটি করেছিলেন এবং একটি সরাই তৈরি করা হয়।। লাহোর ও আগ্রার মধ্যবর্তী এলাকায় গাছ লাগানো হয়।  সেতু নির্মাণ করা হয়। এসময় সড়কটি কে ‘সদক ই আজম’ ও মুঘলদের ‘বাদশাহী সড়ক ‘ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। রাস্তার আফগান প্রান্তটি মাহমুদ শাহ দুররানির অধীনে পুনর্নির্মিত হয়।

এই দীর্ঘ সড়ক নির্মাণ পরিকল্পনার মূল উদ্দেশ্য ছিল প্রশাসনিক কাজের গতি বৃদ্ধি করা। এছাড়া প্রতিরক্ষার কৌশলগত দিক সামনে রেখে সাম্রাজ্যের মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি বিধানের লক্ষ্যও ছিল। সড়কটির মাধ্যমে রাজধানী আগ্রার সঙ্গে সাম্রাজ্যের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোকে যুক্ত করা হয়েছিল। মূল পরিকল্পনায় রাজধানী আগ্রাকে পূর্বে সোনারগাঁও, পশ্চিমে দিল্লি ও লাহোর হয়ে মুলতান, দক্ষিণে বোরহানপুর এবং দক্ষিণ-পশ্চিমে যোধপুরের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়েছিল। সামরিক সুবিধার পাশাপাশি বাণিজ্যিক উন্নতি, ডাক যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং একইসঙ্গে গুপ্তচরদের মাধ্যমে তথ্যাদি সংগ্রহ করাও ছিল সুলতানের মূল উদ্দেশ্য।

গ্র্যান্ড ট্রাংক রোড বা সড়ক-ই আজমকে ঘিরে আরও কিছু কর্মতৎপরতার প্রমাণ মেলে। সরকারি কর্মকর্তা ও জনসাধারণের যাতায়াত সুবিধা প্রদানের পাশাপাশি তাদের বিশ্রামের জন্য রাস্তার উভয় পার্শ্বে নির্দিষ্ট দূরত্বে বিশ্রামাগার ও সরাইখানা নির্মিত হয়েছিল। সরাইখানাগুলোয় খাবারের মান উন্নত ছিল। সড়কটির উভয় পার্শ্বে ছায়াদানকারী বৃক্ষও রোপণ করা হয়েছিল, যা দেখে পথচারীরা মুগ্ধ হতো। ব্রিটিশ আমলে সৈন্য চলাচলের সুবিধা ও ডাক বিভাগের উন্নতির উদ্দেশ্যে প্রয়োজনীয় সংস্কার করে সড়কটি কলকাতা থেকে পেশওয়ার পর্যন্ত বিস্তৃত করা হয়। ব্রিটিশরা ওই সময় সড়কটির নাম পরিবর্তন করে গ্র্যান্ড ট্রাংক রোড নামকরণ করে। কলকাতা থেকে ব্যারাকপুর পর্যন্ত গ্র্যান্ড ট্রাংক রোডের অংশটি পাকা হলেও জহ্বলপুর থেকে এলাহাবাদ হয়ে দিল্লি পর্যন্ত কতগুলো বিচ্ছিন্ন সড়ক ছিল।

শের শাহ সুরি এ রোড নিয়ে বিস্তৃত পরিকল্পনা করেছিলেন , তার সময়ে এ রাস্তাকে ঘিরে নগরায়ন হয়েছিলো, ব্যাবসা বানিজ্যের প্রসার, মসজিদ মন্দির নির্মাণ এবং সামাজিক যোগাযোগএর বন্ধন দৃঢ় করেছিলেন। তার এই সড়ক পরিকল্পনা সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে, তিনি বলেছিলেন, “আল্লাহ যদি আমাকে বাঁচিয়ে রাখে, আমি এমন একটি সড়ক করতে চাই যা ভারত থেকে খাইবার গিরিপথ হয়ে সুদূর মক্কায় গিয়ে শেষ হবে। যাতে আমার মা বোনেরা নিরাপদে হেঁটে হজ্জে যেতে পারেন ”  তার সেই স্বপ্ন পুরুণ হয় নি। ১৫৪৫ সালে চান্দেল রাজপুতের সাথে যুদ্ধের সময় কালিগঞ্জের দূর্গে বারুদের বিষ্ফোরণে শের শাহর মৃত্যু হয়।

সমরনায়ক থেকে সম্রাট হয়ে দিল্লির মসনদে মাত্র পাঁচ বছর অধিষ্ঠিত ছিলেন শের শাহ। কথিত আছে, পাঁচ বছরে যত ভালো কাজ তিনি করেছেন- তার মধ্যে প্রশাসনিক সংস্কার ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন পরবর্তী মোগল সাম্রাজ্যের ভিত রচনা করেছিল। শের শাহর অমর কীর্তি সড়ক-ই আজম, যা পরবর্তীকালে গ্র্যান্ড ট্রাংক রোড নামে পরিচিতি পেয়েছিল, এর সুনাম দুনিয়াজুড়ে। সড়কটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব ও বিশ্বজোড়া পরিচিতি থাকলেও দুঃখের বিষয় হল- বর্তমানে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি ও ব্যক্তিগত মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের নামফলকে লেখা হয় কলেজ রোড, থানা রোড, উপজেলা রোড, হাসপাতাল রোড ইত্যাদি। সড়কটির নামকরণ যাই করা হোক না কেন- সড়ক-ই আজম সড়ক বা গ্র্যান্ড ট্র্যাংক রোডের ঐতিহ্য কি ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে ফেলা যাবে?

১৮৩০ এর দশকে ইষ্টইন্ডিয়া কোম্পানি সড়কটি সংস্কার এর কার্যক্রম শুরু করেন। এশিয়ার অন্যতম প্রাচীন এ সড়ক দীর্ঘতম সড়ক পথ।  এটি বাংলাদেশের মায়ানমার সীমান্তবর্তী টেকনাফ হতে চট্টগ্রাম, ঢাকা, যশোর, কলকাতা, হাওড়া, দিল্লি, আগ্রা, পাকিস্তানের পেশোয়ার হয়ে, আফগানিস্তানের কাবুলে গিয়ে থামে। প্রায় ৩০০০ কি: মি: পথ। আধুনিককালে, শের শাহ সড়ক, মুঘল ই আজম সড়ক, গ্রান্ড ট্রাংক রোড নামে পরিচিতি পেয়েছে। এশিয়াণ হাইওয়ে এই কন্সেপ্টে এগিয়েছে।

ভাবা যায়!?  প্রায় ৫০০ বছরের কম বেশি এ সড়কের বয়স।

এতো বছর আগে এত বড় পরিকল্পনা !! যেখানে আমাদের আধুনিক সময়ে ঢাকা- চট্টগ্রাম মহাসড়ক নিয়ে পরিকল্পনা আর এ সড়ক করতেই অচিন্তনীয় – ঘাম ছুটে যাচ্ছে, আসলেই সে আমলের বাদশাহদের বাদশাহী ব্যাপার সেপার।

শের শাহ সড়ক
শের শাহ সড়ক

তথ্যসূত্রঃ
১। ভারত উপমহাদেশের ইতিহাস (মধ্যযুগ: মোগল পর্ব), এ কে এম শাহনাওয়াজ, ২০১৫, ঢাকা।
২। তারিখ-ই-শের শাহ, আব্বাস সারওয়ানী, সমতট প্রকাশনী, ২০১৫, ঢাকা।
৩। রিয়াজ-উস-সালাতীন, গোলাম হোসায়ন সলীম, অবসর প্রকাশনী, ২০০৮, ঢাকা।
৪। উইকিপিডিয়া।

Visits: 0

মন্তব্য
Loading...
//dolatiaschan.com/4/4139233