শিক্ষা নিয়ে ভাবনা, দুঃখিত দুর্ভাবনা

লেখকঃ কামরুল হাসান মামুন

0 ৬৭

গতকাল বুয়েটের CSE বিভাগে একটি সেমিনার ছিল। এই সংবাদটি পেয়েছি আমাদের EEE বিভাগের সহকর্মী ড. মাইনুল হোসেনের কাছ থেকে। বক্তা ছিলেন অধ্যাপক মোহাম্মদ আতাউল করিম। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস ডার্টমাউথ ইউনিভার্সিটির প্রভোস্ট এবং এক্সেকিউটিভ ভাইস চ্যান্সেলর। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানে পড়েছেন এবং পরে যুক্তরাষ্ট্রের আলাবামা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ থেকে পিএইচডি ডিগ্রী অর্জন করেন। পিএইচডি ডিগ্রীর পর তিনি আর বাংলাদেশে ফিরে আসেননি কারন তিনি নিশ্চিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে চাকুরী হবে না কারণ উনার পিএইচডি ডিগ্রী ইঞ্জিনিয়ারিং-এ আর বুয়েটে চাকুরী হবে না কারণ উনার আন্ডারগ্রাজুয়েট ইঞ্জিনিয়ারিং-এ না হয়ে ফিজিক্সে। এই ক্ষেত্রে আমাদের মাহবুব মজুমদারের কথা মনে পরল। যার আন্ডারগ্রাজুয়েট ইঞ্জিনিয়ারিং-এ আর পিএইচডি ফিজিক্সে এবং তাও কেমব্রিজ থেকে তত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানে এবং পোস্ট-ডক ইম্পেরিয়ালে। উনিও ফিরে এলেন এবং সত্যিই উনাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নেয়নি। থাঙ্কস গড এইসব বলদামি চিন্তাভাবনার নিয়মকানুন পৃথিবীর উন্নত দেশে নাই। থাকলে উনি আজ একাডেমিয়াতে থাকতে পারতেন না। থাঙ্কস গড যে উনি দেশেফিরে আসেননি। আসলে উনার আজকের যেই অর্জন (RG=৪০.৪৯, citations=৪৬৭৫) তার দশ ভাগের এক ভাগ হতো কিনা সন্দেহ। এইজন্যই আমি সবসময় বলি: বাংলাদেশের নিয়মকানুনগুলো হলো এমন যে এখানে টেলেন্টস বানানো হয়না বরং টেলেন্টস হত্যা করা হয়।

ওই সেমিনারে যাবো। গাড়িতে উঠেই প্রথম দুইজনের সাথে যোগাযোগ করলাম। একজন বুয়েটের শিক্ষক এবং আমার প্রিয় ছাত্র অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বাসিত এবং অন্যজন ড. মাইনুল হোসেন। বুয়েটের ECE ভবনে ঢুকে মাত্রই দেখি ওই দুইজন আমার জন্য অপেক্ষা করছে। তিনজনে মিলে ভবনের লেভেল ৫-এ সেমিনার রুমে ঢুকেই প্রথম ঠাসকি: বড়জোর ৭-১০ জন মানুষ। ঢুকেই অধ্যাপক কায়কোবাদ, অধ্যাপক আতাউল করিমসহ কয়েকজনের সাথে কুশল বিনিময় করে একটি আসনে বসলাম। কিছুক্ষনের মধ্যেই বক্তৃতা শুরু হলো! শিরোনাম: “Global Research Rankings: A Bangladesh Context”!

একটু বলে নেওয়া ভালো যে অধ্যাপক করিম যুক্তরাষ্ট্রে থাকলেও দেশ নিয়ে এবং দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে যেই পরিমান ডাটা বেসড গবেষণা করেন বাংলাদেশের অন্য কেউ করেন কিনা অন্তত আমার জানা নেই। আমাদের অধিকাংশ শিক্ষাবিদই শিক্ষা নিয়ে হাওয়ার উপর কথা বলেন। বর্তমান যুগ হলো ডাটা সাইন্সের। লম্বা সময়ের তথ্য উপাত্ত থাকলে যেকোন একটি বিষয়ের ডাইনামিক চিত্র পাওয়া যায়। যার উপর বেসড করে বর্তমানে প্রায় প্রতিষ্ঠান এবং দেশই নানা উন্নয়নমূলক প্রকল্প হাতে নেয়। সম্ভবত আমরাই পৃথিবীর একমাত্র দেশ যারা ডাটা নিয়ে মাথা ঘামাই না।

উনি শুরুই করলেন শিক্ষা দীক্ষায় গ্লোবাল প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের অবস্থান নিয়ে কিছু চিত্রের মাধ্যমে। ওই চিত্রগুলো দেখে মনে হলো শিক্ষা দীক্ষায় পৃথিবীর দেশগুলো ১০০ মিটার স্প্রিন্ট বা দৌড় প্রতিযোগিতায় আছে। ২০১১ সালে চীন, আমেরিকা, তুর্কি, ব্রাজিল, ইরান আর বাংলাদেশের অবস্থান। প্রথমেই বলে নেই ওই প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের উপস্থিতি রাতের বিশাল আকাশে একটি ডট-সম। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো চীন, আমেরিকা, তুর্কি, ব্রাজিল, ইরান, কোরিয়া, জাপান, ভারত কি সাংঘাতিক মল্ল যুদ্ধে লিপ্ত। কে কাকে ছাড়িয়ে যাবে। এর মধ্যে চীনের উন্নতির ডাইনামিক চিত্র পৃথিবীর সকল দেশের জন্য একটি উদাহরণ হতে পারে। কিন্তু তুর্কি, ব্রাজিল, ইরানের উন্নতির ডাইনামিক চিত্র দেখেও চোখ কপালে উঠে যায়। এদের উন্নতির হার যুক্তরাষ্ট্রের উন্নতির হার থেকে অনেক অনেক বেশি। উন্নতির এই ধনাত্মক হার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। উন্নতি হলেই কেউ হাত গুটিয়ে বসে থাকলে চলবে না কারণ এগিয়ে যারা আছে তারা আরো দ্রুত যেতে চাচ্ছে আর পিছিয়ে যারা আছে তারাও এমন ড্রাইভিং ফোর্স এপলাই করছে তারাও সকলকে ছাড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। দুঃখ হলো আমরা এই দিকে দৃষ্টিই দেই নাই। যেন আমরা এই বিষয়ে ওয়াকিবহালই নই।

যারা এই প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে চায় তাদের শুরু করতে হবে শিক্ষায় বিশাল পরিমানের বিনিয়োগ আর পৃথিবীর প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিয়ে একটি বিশাল ভিশনারি পরিকল্পনা নিয়ে। যেখানে জাতিসংঘের প্রেসক্রিপশন হলো শিক্ষায় যেন প্রতিটি দেশ তার জিডিপির অন্তত ৫% বরাদ্দ দেয় আমাদের দেশ কন্সিস্টেন্টলি ২%-এর আশেপাশে দিয়ে আসছে নির্বিশেষে কে ক্ষমতায় আছে। অথচ জনসংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশ একটি বিশাল দেশ। আমাদের একমাত্র রিসৌর্স হতে পারে আমাদের মানুষ যদি আমরা আমাদের মানুষদের মানুষ বানাতে পারি। দেখতে মানুষগুলোকে সত্যিকারের মানুষ বানানোর একমাত্র পথ শিক্ষা। আমরা আজ পর্যন্ত এটাই বুঝতে পারলাম না। ইনিয়েবিনিয়ে নানা ছলচাতুরি করে মানুষের ফোকাসকে এই দিক থেকে সরিয়ে রাখা হয়েছে। মুখে মুখে শুধু বলা হয় এই সরকার নাকি শিক্ষায় মারাত্মক উন্নতি করছে।

২০১৬ সালে কালের কণ্ঠে দেখলাম আমাদের ইউজিসির চেয়ারম্যান মহোদয় একটি আর্টিকেল লিখেছেন। পড়ে আমি ঠাস্কি খাইলাম। উনার চিন্তা চেতনার দৌরাত্ম আর বন্ধ্যাত্ব দেখে দুঃখবোধ হলো। উনি প্রশ্ন তুলছেন কেন আমাদের দুএকটি নামিদামি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে বিদেশী বিশেষকরে উত্তর আমেরিকার ডিগ্রী প্রীতি। আরে মহাশয় এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো একটুআধটু যেইটুকু সুনাম অর্জন করেছে সেটি কেবল এই কারণেই। ভাবা যায় এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যদি কেবল বাংলাদেশে অর্জিত পিএইচডি ডিগ্রী ওয়ালাদের শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ দিত তাহলে এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থান কোথায় থাকতো। অথচ এদেরকে তিনি বিদেশী কুকুর প্রীতির সাথে তুলনা করেছেন। ওই একই আর্টিকেলে শিক্ষা ও গবেষণায় বর্তমান সরকারের বিনিয়োগে তিনি মারাত্মক সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন। ভাবা যায়? যেই প্রতিষ্ঠানের কাজ হলো আরো বিনিয়োগ এবং আরো বিনিয়োগ করতে সরকারকে অনবরত প্রচণ্ড চাপে রাখা আর সেই প্রতিষ্ঠানের প্রধান সন্তুষ্টির ঢেকুর তুলছেন। তাহলে এই দেশ নিয়ে আমরা কি আশা করব?

ফিরে আসি অধ্যাপক আতাউল করিমের বক্তব্যে। তিনি ডাটা দিয়ে দেখিয়েছেন গবেষণায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কিভাবে পেছাচ্ছে। ২০১১ সালের ডাটা অনুসারে দেশের সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। আজকে বুয়েট হলো দেশ সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। তিনি বলেছেন আমাদের ৭৩-এর অধ্যাদেশই আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে নষ্টের মূল। শিক্ষায় মেরিটোক্রেসি আর ডেমোক্রেসি সহাবস্থান করতে পারে না। এই কথা আমিও আমার নানান লেখায় অনেকবার বলেছি। আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল সমস্যা “শিক্ষকদের রাজনীতি ও নির্বাচন”! শিক্ষকরা রাজনৈতিকভাবে সচেতন থাকবেন কিন্তু দলীয় বৃত্তে বন্দি থাকবেন না। দলীয় বৃত্তে বন্দি থাকলে অন্ধ আনুগত্ব চলে আসতে বাধ্য। এই নির্বাচন এবং দলীয় আনুগত্যের কারণেই শিক্ষকরা এখন গবেষণার পরিবর্তে সারা বছর ধরে নির্বাচনী ক্যাম্পেইন করে। কেউ ভালো কাজ না করলেও বা অন্যায় করলেও কিছু বলা যায় না পাছে ভোট না পায়। ৭৩-এর পরের একটি ডাইনামিক চিত্র দেখলে স্পষ্ট হবে যে এই নির্বাচন পদ্ধতির কারণেই শিক্ষক নিয়োগ ও প্রমোশন নীতিমালা দিন দিন শিথিল করা হয়েছে। অথচ সারা পৃথিবীতে যারা ভালো করছে তারা শিক্ষক নিয়োগ ও প্রমোশন নীতিমালা কঠিন থেকে আরো কঠিন করছে। আমরা এই সহজ কথাগুলো যতদিন না বুঝব আমাদের ক্রমাবনতি কেউ ঠেকাতে পারবে না।

Visits: 0

মন্তব্য
Loading...
//sheegiwo.com/4/4139233