সমস্যা বরের নয় বউয়ের…

0 ১১৭

ছোটবেলায় আমাদের ঢাকায় প্রত্যেকটা বিয়েতে দেখতাম একই সেন্টারে উপর-নিচ তলায় মহিলা-পুরুষদের জন্য আলাদা জায়গা থাকতো। এদিকে পর্দা রক্ষার  জন্য ছেলে-মেয়ে আলাদা ব্যবস্থা করলেও ছেলেদের সেকশান থেকে কেউ কেউ মেয়েদের সেকশানে উঠে আসলেও কেউ বাঁধা দিতো না, কিছু বলতো না। ছেলেদের ব্যক্তিগত ইচ্ছার উপর ছেড়ে দিতো। তাই আলাদা স্থান বরাদ্দ থাকলেও প্রায়ই দেখতাম মেয়েরা ছেলেদের স্থানে  না গেলেও ছেলেরা মেয়েদের তলায় এসে যথারীতি জটলা বেঁধে হাজিড়। এদিকে বর্তমানে দেখছি- বিভিন্ন কমিউনিটি সেন্টারগুলো এমনভাবে আর্কিটেকচারাল ডিজাইন দিয়ে তৈরি করা হচ্ছে যে- ছেলেমেয়েদের মধ্যে যাতে free mixing হয়। বড়ও একটা হল রুম, সাথে ডাইনিং স্পেস। একপাশে বসার জায়গা আরেকপাশে খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা। মহিলা-পুরুষ একসাথে থাকবে। আর সবাই যাতে বর-কনেকে দেখতে পারে তাই হল রুমের এমন জায়গায় বর-কনের একসাথে বসার ব্যবস্থা।

 

 

এহেন পরিস্থিতিকে, অনেকে ঝামেলামুক্ত (ছেলে-মেয়েদের পর্দা নিয়ে যারা ভাবেন না, আলাদা ব্যবস্থা করতে অনাগ্রহী), স্মার্ট মনে করলেও সমস্যায় পড়েন তারা, যারা জানেন- পরপুরুষের সামনে সাজসজ্জা করা (মহিলাদের জন্য) গুনাহের কাজ আর যারা (পুরুষরা) জানেন-দৃষ্টি সংযত রাখার বিধান। তাই বর্তমানের প্রায় সব বিয়ে যেহেতু কো-এরেঞ্জমেন্টে হয়, তাই দেখা যায়- অনেক মেয়েরা (যারা পর্দার গুরুত্ব বুঝে) সাজতে চাইলেও (স্বাভাবিকভাবেই বিয়েতে আপনজন সবার সাথে অনেক দিন পর দেখার একটা সুযোগ হয়, সবাই বেশ সেজেগুজে আসে, আর সেই সবার মাঝে নিজেকে সুন্দর লাগুক-এটা সবাই চায়) ছেলে-মেয়ে একসাথে থাকলে যেহেতু তার ওপর অন্য ছেলের দৃষ্টি পড়তে পারে তাই সাজতেও পারে না। তাই দেখা যায়- অনেক মেয়ে বিয়েতে এসেও হিজাব দিয়ে থাকতে বাধ্য হচ্ছে। সুতরাং, আমাদের এমন একটা ব্যবস্থা করতে হবে- যাতে মেয়েরা স্বাভাবিক ভাবে তাদের সাচ্ছন্দ্যমত সাজতে পারে আর  ছেলেরাও তাদের দৃষ্টির গুনাহ থেকে নিরাপদে থাকে।

 

 

হ্যা, সেই পদ্ধতি অবশ্যই করা যায়। শুধু লাগবে একটা Strong নিয়্যত, পরিবারের সবার সহযোগিতা এবং ইচ্ছাশক্তি। বিয়েতে ছেলে-মেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা ভাবে বসা-খাওয়ার ব্যবস্থা থাকবে। সেন্টার যদি দু’তলার হয়, তবে নিচ তলা ছেলে-উপরের তলা মেয়ে, আর এক তলা হলে হলরুমের মাঝে পর্দা টেনে পার্টিশন করতে হবে। মেয়েদের প্রাইভেসিতে যাতে সমস্যা না হয়। ছেলেদের ডাইনিং এ ছেলে খানসামা তথা ওয়েটার আর মেয়েদের ডাইনিং এ মহিলা খানসামা থাকবে।

 

 

এদিকে প্রশ্ন উঠতেই পারে বা অনেক পুরুষ বলতেই পারেন যে- “আশ্চর্য! আমি আমার মা/বোন/স্ত্রীর সাথে দেখা করতে যেতেই পারি, সেখানে আমাকে কেনো বাধা দেয়া হবে? বা এমন কথাও উঠতে পারে- ওমা! বিয়েতে এসে যদি বউকেই না দেখি তাহলে আসলাম কেন? বা এমন কথাও উঠতে পারে- “দেখুন! আমাদের নজর আর নিয়্যত দুটোই ভালো, তাছাড়া আমরা তো বউ এর মামাতো/ফুফাতো/খালাতো/চাচাতো ভাই/ দুলাভাই, — আমরা আমরাই তো। আমরা আপন মানুষ উপরে গেলে সমস্যা কি”? উত্তরগুলো ক্রমানুসারে দিচ্ছি। নিজের মা/বোন/স্ত্রী কারো সাথে দেখা করতে বা কথা বলতে সমস্যা নেই, তবে আপনি তাদের সাথে দেখা করতে গেলে সেটা অপর এক মহিলার পর্দায় ব্যাঘাত ঘটাবে। যেটা আপনাকে বুঝতে হবে। কি নিশ্চয়তা আছে যে, আপনার নজর অন্য কোনো মহিলার ওপর যাবে না? যদিও নজর দেয়াটা উচিত নয়। সুতরাং, আজকাল যেহেতু সবার হাতে হাতে মোবাইল, তাই সেটার সদব্যবহার করা উচিত। ফোন করে নিজের আপনজনকে ডেকে নিন বা প্রয়োজনীয় কথা বলুন। উপরে যাওয়ার দরকার কি? এটা আমাদের সমাজে বেশ প্রচলিত কথা যে, বিয়ে থেকে আসলেই (ধরি, এক ছেলে তার বন্ধুর বোনের বিয়ে খেয়ে এসেছে) সবাই জিজ্ঞাস করে-“ কি রে, বউ কেমন দেখলি?  কি! বউ না দেখেই চলে এলি? তাহলে গিয়েছিলি কি করতে”?  আসলে বউ দেখাটা কার জন্য জায়েজ আর কার জন্য নয়- এটা সবার জানা উচিত। মাহরাম পুরুষ ব্যতীত বউ এর সাজ দেখার অধিকার কারো নেই। তাই যে কোনো ছেলের এটা বুঝা উচিত, আমি বউকে দেখার অধিকার রাখি কি রাখি না। এদিকে আমি কারো নিয়্যত বা দৃষ্টি খারাপ এমন বলিনি। আমরা সবাই ভালো ,কিন্তু সমস্যা হচ্ছে যারা ভালো তাদেরকেই শয়তান পেয়ে বসে, কারণ শয়তান আল্লাহ’র কাছে প্রতিশ্রুতি দিয়েই এসেছে যে, সে তাঁর প্রিয় বান্দাকে বিভ্রান্ত করবেই। আপনি মামাতো/ফুফাতো….. ইত্যাদি হতে পারেন, তবে নিজের স্বার্থে এবং  জীবনকে সহজ- করতেই মাহরাম-গায়ের মাহরাম এর বিধান জানা প্রত্যেক ছেলে-মেয়ের উচিত। ছোটবেলার খেলাধুলার সম্পর্ক বড় হয়ে ভিন্ন রূপ নেয়, সচেতনতা বশত পর্দা মেনে চলতে হয়- তার মানে এই নয় যে- পর্দা মেনে চলা মানে, কথা-বার্তা বন্ধ করে দেয়া। আমি এমনও এক মেয়ের ঘটনা জানি- সে যখন জেনেছে যে, খালাতো ভাই গায়ের মাহরাম এবং তাদের সাথে পর্দা করতে হবে- সেই মেয়েটা তখন থেকে তাদের সামনে আসা এমনকি কথাবার্তাই বন্ধ করে দিলো। অথচ পর্দা মেনে চলা মানে আত্মীয়তা থেকে দূরে সরে যাওয়া নয়। পর্দাপ্রথা  সম্পর্কের অন্তরায় নয়।  আত্মীয়স্বজন আল্লাহ’র নিয়ামত স্বরূপ। এদিকে, আত্মীয়দের এটা বুঝা উচিত- আমি কি করে আমার অপর আত্মীয়’র অধিকার অটুট রাখতে পারি। আর নিজের পর্দা ঠিক রেখে অন্যের পর্দার সম্মান করতে পারি। তাই এই অধিকার দেয়ার মানসিকতা একে অপরের মধ্যে থাকতে হবে। এজন্যই শুরুতে বলেছি, বিয়েতে আলাদা ব্যবস্থাপনা সবার জন্য সহায়ক ভূমিকা তখনই রাখবে যখন পরিবারের সবাই উপলব্ধি করে তা কায়েম করতে সচেষ্ট হবে।

 

 

এতক্ষণ মেহমানদের নিয়ে বলছিলাম। এবার একটু বর-কনের দিকে তাকাই। পর্দার দিক থেকে বরের কোনো সমস্যা না হলেও যত সমস্যায় পড়তে হয় বউকে। অনেকেই হয়ত বলবেন এবং বলেনও- “আরে, বিয়েতে আবার এত পর্দা টর্দা কি”? হ্যা, অনেকটা এমনই মনোভাব থাকে অধিকাংশ বর-কনে এবং তাদের পরিবারের। অনেক হিজাবী মেয়েদেরকেও দেখা যায়- বিয়ের সময় পর্দা উঠে যায়। প্রশ্ন হলো- পর্দা কি তাহলে শুধু বাসা থেকে কলেজ যাওয়া পর্যন্ত? যদিও পর্দার বিধান এমনটি  বলে না। পর্দার নির্দেশনা একই। মাহরাম ব্যতীত আর সবার সামনে পর্দা করতে হবে। তা, বিয়েতে মাহরাম ব্যতীত আর সবার সামনে বেপর্দা হওয়া জায়েজ হয়ে যায়? তাই তো দেখি নির্বোধ বর পর্যন্ত নিজের ১০/১২ জন বন্ধু নিয়ে বউ এর সামনে এসে ফটোসেশন শুরু করে দেয়। হ্যা, নিজের বউ কে নিয়ে অন্যের সামনে (একটা সীমার মধ্যে থেকে) গর্ব করতেই পারেন, তবে তাই বলে বিয়ের মঞ্চে সাজগোজ অবস্থায় থাকা নিজের বউকে গায়ের মাহরাম তথা বন্ধুর সামনে হাজিড় করা ঠিক নয়। আপনার স্ত্রী তো বেপর্দা হবেই সেই সাথে তার জীবনের প্রতিও যেনো আপনি শত্রুতা করলেন। এমন অনেক ঘটনা পত্রিকায় আসে- বন্ধুর সাথে স্ত্রীর পালিয়ে যাওয়া, কিংবা তাদের ষড়যন্ত্রে স্বামীর মৃত্যু। আমি কারো বন্ধুদের খারাপ বলছি না, তবে কথাটা সেই আগের মতোই- কেউ জানে না, কখন তার দ্বারা গুনাহ হয়ে যাবে, তাই সেইফ সাইডে থাকা উত্তম। নিজেই নিজের পায়ে কুড়াল মারার মতো কাজ করা থেকে বিরত থাকা উচিত। আর পরিচিতির জন্য কখনো আপনার বন্ধু বাসায় আসলো, আপনার স্ত্রীর সাথে দেখা হলো সেটা আলাদা প্রসঙ্গ, তবে বিয়ের সাজে দেখা ঠিক নয়।

এদিকে দুঃখের সাথে বলতে হয়- বউ এর সাজসজ্জা দেখার অধিকার তার স্বামীর থাকলেও কো-এরেঞ্জমেন্টে  অনেক গায়ের মাহরাম পুরুষ বউকে দেখে ফেলে এতে বউ-এবং সেসকল পুরুষ সবাই গুনাহের শামীল হয়। উভয়ের পর্দার নিয়ম লঙ্ঘিত হয়। অনেক সময় আবার এমনও দেখা যায়- মেয়েটি ইসলামি মাইন্ডেড তবে তার পরিবার সেরকম না হওয়ায় বিপাকে পড়ে যায় মেয়েটি। বাধ্য হয়ে বিয়ের দিন এক প্রদর্শনীর পুতুলের মতো মঞ্চে বসে থাকে মাহরাম-গায়ের মাহরাম সবার দেখার জন্য। আবার আজকাল এমনও হয় যেহেতু পর্দা লঙ্ঘিত হবে- জানা কথা, তাই অনেক বউ হিজাব দিয়ে বসে থাকেন। তবে প্রশ্ন হলো জাকজমক ড্রেস আর হেভি মেকআপের কি হবে? পর্দা কি তাহলে ঠিক মতো হলো? সুতরাং  স্বয়ং বউ যাতে স্বাচ্ছন্দ্যমত সাজতে পারে এবং  কারোই পর্দা যাতে লঙ্ঘিত না হয়- সেই দিকে খেয়াল রেখেই বিয়েতে ছেলে-মেয়েদের  আলাদা ব্যবস্থাপনা করা অতি জরুরী।

Visits: 1

মন্তব্য
Loading...
//ewhareey.com/4/4139233