ভাষা ও লিপির প্রসঙ্গ।

0 ৯০

এই সূত্রে উল্লেখযোগ্য যে সপ্তদশ শতাব্দীতেও হিন্দি নামে কোনও ভাষা ছিল না, যেমন দশম শতাব্দীতে হিন্দু ধর্ম নামে কোনও ধর্মের অস্তিত্ব ছিল না। গজনীর মাহমুদের ভারত আক্রমণগুলির পূর্বে ভারতে ছিল ব্রাহ্মণ্য ধর্ম, বৈষ্ণব ধর্ম, শৈব ধর্ম, শাক্ত ধর্ম, গাণপত্য ধর্ম প্রভৃতি বহু ধর্ম। ইসলাম ধর্মাবলম্বী তুর্কি-পাঠান-পারসিকরাই হিমালয়ের ও হিন্দুকুশের দক্ষিণে প্রচলিত ঈশ্বরবাদী সমস্ত ধর্মকে একসঙ্গে যোগ করে হিন্দুধর্ম নামে একটি সুপ্রশস্ত আধারে স্থাপন করেছিল।

একই রকম ব্যাপার ঘটল সাতশ বছর পরে। বর্তমানে যাকে হিন্দি ভাষা বলা হয় তা আসলে মধ্যযুগের প্রধান ছয়টি ভাষার সমাহার। এই ছয়টি ভাষা হল :

১। সুরদাস, ভূষণ, মীরা প্রভৃতি যে-ভাষায় পদ রচনা করেছেন সেই ব্রজ-ভাষা। 
২। তুলসীদাস রচিত রামচরিতমানসের অওধী বা অবধী ভাষা। 
৩। মাড়োয়ারি, ডিঙ্গল প্রভৃতি রাজস্থানী ভাষা – এই ভাষায় ‘কৃষ্ণ- রুক্মিণী’, ‘ঢোলা-মারু’ প্রভৃতি বিখ্যাত গাঁথা কাব্য আছে এবং মীরার ভজনগুলিও প্রথমে এই ভাষায় রচিত হয়ে পরে ব্রজভাষায় রূপান্তরিত হয়। 
৪। পাঞ্জাবী ভাষা যাতে শিখ গুরুগণ বাণী রচনা করেন। 
৫। পাহাড়ি ভাষা। 
৬। ভোজপুরী, মৈথিলী, মগহী প্রভৃতি ভাষা নিয়ে বিহারী ভাষা পরিবার।

এই সঙ্গে মনে রাখা ভাল যে মধ্যযুগের সবচেয়ে প্রসিদ্ধ সমন্বয়বাদের কবি কবীর ভোজপুরী, অওধী, ব্র্জভাষা এই তিনটি ভাষার সংমিশ্রণে এক নিজস্ব ভাষা সৃষ্টি করেছিলেন অর্থাৎ তার ভাষাও তার ভাবনারই প্রকাশ। আবার এগুলির সঙ্গে উর্দু ভাষা মিশে গিয়ে গড়ে উঠেছে আগ্রা-দিল্লি-লখনৌর খাড়ী বোলি হিন্দি।

এই মিশ্রণের প্রক্রিয়া ঊণবিংশ শতাব্দীর কলকাতাবাসীদের মিশ্রসমাজে একটা বিশেষ রূপ পায়। কলকাতা শহর গড়ে উঠার সঙ্গে সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যের আর সেই সঙ্গে ইউরোপীয় সংস্কৃতির আকর্ষনে গঙ্গা বিধৌত সমস্ত উত্তর ভারতের, উপরন্তু পাঞ্জাব রাজস্থান গুজরাট সিন্ধু প্রভৃতি অঞ্চল থেকে দলে দলে নানাভাষী মানুষ এসে জড়ো হয কলকাতায়। এই বহুভাষী মিশ্র জনগোষ্ঠীর ব্যবহারিক প্রয়োজনে যে নতুন সামান্য ভাষা মুখেমুখে গড়ে ওঠে তা-ই আধুনিক হিন্দি ভাষার প্রথমাবস্থা।

এদিকে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে ইংল্যান্ড থেকে আগত ইংরেজ যুবকদের একটা স্থানীয় ভাষা তালিমের প্রয়োজন হচ্ছিল – সেটা এমন একটা ভাষা হবে যা দিয়ে পাঞ্জাবী রাজস্থানী অওধী ভোজপুরী মৈথিলী প্রভৃতি বিভিন্ন ভাষাভাষীর সঙ্গে ইংরেজ সিভিলিয়নরা কথোপকথন করতে পারবে। ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের অধ্যক্ষ জেমস গিলখ্রাইস্ট তেমন একটা ভাষাকে ব্যাকরণবদ্ধ ভাবে গড়ে তোলার কাজে লালুজী লাল, পন্ডিত সদল মিশ্র প্রমুখ অধ্যাপকদের নিয়োগ করলেন। ওদিকে শ্রীরামপুরের ব্যাপটিস্ট মিশনারিগণ ভারতের বৃহত্তর জনসাধারণের কাছে বাইবেলের বাণী পৌছে দেওয়ার জন্য সাহায্য নিলেন ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে সৃষ্ট হিন্দিরই। হিন্দি সাংবাদিকতার ইতিহাস শুরু হল ‘উদন্ত মার্তন্ড’ নামের সাপ্তাহিক পত্রিকা থেকে যা কলকাতা থেকেই প্রথম প্রকাশিত হয়। তারপরে বারাণসীনিবাসী একজন বাঙালি প্রকাশ করলেন ‘সুধাকর’ নামে একটি পত্রিকা। এইভাবে উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে হিন্দির বাল্য ও কৈশোর কাটে।

… একই সঙ্গে শুরু হল উর্দু এবং হিন্দির মধ্যে শক্তিপরীক্ষা। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে উত্তর ভারতের সম্ভ্রান্ত সমাজে তিনটি ভাষার সম্যক প্রচলন ছিল। পারসিক, সংস্কৃত ও উর্দু। প্রথম দুটি ছিল বিদ্বান ব্যাক্তিদের বিদ্যা অনুশীলনের ও আলোচনার ভাষা, কিন্তু ধর্মাধর্ম নির্বিশেষে সাধারণ মানুষের আলাপের ও বিদ্যালয়ে শিক্ষার ভাষা ছিল উর্দু।

ইংরেজদের দ্বারা মুঘল বাদশাহ বাহাদুর শাহের নির্বাসনের পরে কোন কোন হিন্দু মহল থেকে উর্দুকেও নির্বাসনে পাঠিয়ে তার স্থানে হিন্দির অভিষেক সম্পানের দাবি উঠতে শুরু করে। কিন্তু অনেক অভিজাত বা শিক্ষিত হিন্দুর কাছেও হিন্দির জন্য ওই দাবি নিম্নরুচির পরিচায়ক ছিল। এর মধ্যে দুই প্রজন্মের বিরোধও নিহিত ছিল। লালা লাজপত রাই তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন যে, তিনি যখন আর্য সমাজে দীক্ষা নিয়ে হিন্দির প্রচার শুরু করেন তখন তার পিতা ক্ষুব্ধ হযে বলেছিলেন যে উর্দু হল শরিফ বা গণ্যমান্যদের ভাষা আর হিন্দি হল বাজারের বা ক্রেতা বিক্রেতার ভাষা।

বিশ শতকের ষষ্ঠ দশকে সভাপতির একটি ভোটের জোরে হিন্দিকে ভারতের রাষ্ট্রভাষা করা হয়। কিন্তু হিন্দির প্রচারকগন সমস্ত হিন্দু ধর্মাবলম্বীদেরকে উর্দু বর্জন করে হিন্দি গ্রহণের জন্য প্রচন্ড আন্দোলন শুরু করেন। ফলে অনিবার্য ভাবে ভাষার বিষয়টা সাম্প্রদায়িক চরিত্র, বর্ণ ও রূপ লাভ করে এবং সাম্প্রদায়িক বিভেদে ও বিরোধে ইন্ধন জোগায়। একদিকে হিন্দু ধর্মসভা ও গোরক্ষিণী সভাগুলির উর্দুর বিপক্ষে ও হিন্দির পক্ষে তীব্র তৎপরতা অন্যদিকে মুসলিম মজলিস ও মৌলবী জামায়েতগুলির উর্দুর পুরনো ইজ্জৎ রক্ষার জন্য মরিয়া লড়াই।

স্বভাবতই সাম্প্রদায়িক কারণে অর্থাৎ হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য হিন্দির বলবৃদ্ধি অনিবার্য ছিল। আদিতে মুনসি প্রেমচন্দ ছিলেন উর্দু সাহিত্যিক, কিন্তু ক্রমবর্ধমান হিন্দিবাদীদের এবং অবশ্যই সংখ্যাগরিষ্ঠতার চাপে ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে তিনিও উর্দুকে বর্জন করে বৃহত্তর পাঠকসমাজের কাছে পৌঁছবার জন্য হিন্দিকে বরণ করেন। বর্তমানে তিনিই শ্রেষ্ঠ হিন্দি সাহিত্যিক রূপে স্বীকৃত।

প্রকৃতপক্ষে ভারতবর্ষে ব্রিটিশ সরকার প্রতিষ্ঠার পর থেকে ভাষা ও লিপির প্রশ্নকে হাতিয়ার করে উত্তর ভারতের উদ্যোগী শহরে হিন্দু সমাজ নিজেদের স্বতন্ত্র সাম্প্রদায়িক পরিচয় পরিস্ফূট ও প্রতিষ্ঠা করার নামে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে মুসলিম সমাজকে ধিকৃত, পৃথক ও বিচ্ছিন্ন এক নিম্নতর ধাপে নামিয়ে দেয়॥”

– সুরজিত দাস গুপ্ত / ভারতীয় মুসলমানদের সংকট ও সমস্যা ॥ [ ইতিহাস সংকলন, প্রণয়ন ও গবেষণা সংস্থা – জানুয়ারি, ২০০৮। পৃ: ৪৫-৪৭ ]

Visits: 5

মন্তব্য
Loading...
//lemsoodol.com/4/4139233