সম্প্রতি পালিত হলো, ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস’। ১৮৫৭ সালে অর্থাৎ দেড়শ বছরেরও বেশি আগে আমেরিকার নারী শ্রমিকদের দাবি আদায়ের আন্দোলনের ইতিহাসকে স্মরণ করে সারা বিশ্বে যে দিবসটি পালিত হচ্ছে মহাআড়ম্বরে, এখন এই দিবসটিকে বৈশ্বিক পর্যায়ে নারীর সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের একটি তাৎপর্যপূর্ণ হাতিয়ার হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। সুধিজনরা বলছেন, সেই সঙ্গে রাষ্ট্রীয় ও প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে নারী-পুরুষের সহঅবস্থান ও সাম্যের সমাজ প্রতিষ্ঠার আদর্শ বাস্তবায়নে সরকার ও নাগরিক সমাজের দায়বদ্ধতা পুনর্ব্যক্ত করার অবকাশ সৃষ্টি করে ৮ মার্চ।
প্রতিবারের মতো এবারও বেশ ঘটা করে পালিত হলো ‘বিশ্ব নারী দিবস’। নারীর অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেই সেই নিউইউর্কের পথ অনুসরণ করে বাংলাদেশেও এই দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। গত বছরে আন্তর্জাতিক নারী দিবসের প্রতিপাদ্য ছিল ‘নারীর ক্ষমতায়ন-মানবতার উন্নয়ন’। সেই ধারাবাহিকতায় এবং ২০১৫-পরবর্তী বৈশ্বিক উন্নয়ন এজেন্ডা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল বা এসজিডি) বাস্তবায়নের পূর্বশর্ত হিসেবে জাতিসংঘ ঘোষিত ২০১৬ সালের আন্তর্জাতিক নারী দিবসের প্রতিপাদ্য হচ্ছে ‘প্ল্যানেট ৫০-৫০: স্টেপ ইট আপ ফর জেন্ডার ইক্যুয়ালিটি’। অর্থাৎ অধিকার, মর্যাদায় নারী-পুরুষ সমানে সমান। যার অন্যতম উদ্দেশ্য ২০৩০ সালের মধ্যে ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও বৈষম্যমুক্ত একটি টেকসই বৈশ্বিক রূপান্তরের উদ্দেশ্যে ‘নারীর সমতা অর্জন।
এই মনোভাবকে ধারণ করে স্বাধীনতার পর থেকে বার বার বাংলাদেশের নেতৃত্বে এসেছেন নারী। গত ২৫ বছর ধরে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করে আসছেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। এছাড়া সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা এবং সংসদের বাইরে থাকা প্রধান বিরোধী দলের নেতাও নারী। জাতীয় সংসদের উপনেতা, স্পিকার, একাধিক মন্ত্রী, এমপি, সচিব, রাষ্ট্রদূত, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডিপুটি গভর্নরের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদ অলঙ্কৃত করছেন তারা।
সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি, খেলাধুলা, সাংবাদিকতা, কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান, বিচারলায়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এমনকি হিমালয়ের চূড়া জয়ের ক্ষেত্রেও পুরুষের পাশাপাশি নারীদের সরব উপস্থিতি জানান দিচ্ছে সর্বক্ষেত্রে বাংলাদেশের নারীদের অন্তর্ভুক্তির সোনালী গল্প।
বিশ্বে আর কোনো দেশের রাজনীতিতে নারীর এত উচ্চ আসন নেই। এর স্বীকৃতিও মিলছে বিশ্বজুড়ে। হার্ভার্ড ও ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যৌথভাবে করা ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের ‘দ্য গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ রিপোর্ট, ২০১৫’- অনুযায়ী নারী-পুরুষবৈষম্য বা জেন্ডার গ্যাপ হ্রাসে বাংলাদেশ ৭৫তম স্থান থেকে ৬৪তম স্থানে উন্নীত হয়েছে। নারী উন্নয়নে বাংলাদেশ সার্বিক সূচকে বিশ্বে ৬৪তম অবস্থানে থাকলেও এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলভুক্ত ২৪টি দেশের মধ্যে অস্ট্রেলিয়ার পরেই দ্বিতীয় শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে। বাংলাদেশের এই ঐতিহাসিক রূপান্তরে নারীর ভূমিকা ছিল অপরিসীম।
কিন্তু এতসব সত্ত্বেও কিছু ঘটনার কারণে বাংলাদেশের প্রান্তিক নারীগোষ্ঠী যারা আছেন- মা, স্ত্রী, কন্যা, কাজের মেয়ে, গৃহপরিচায়িকা, ইত্যাদি নামে; তারা এখনো কতটুকু নিরাপদ বা সম্মানজনক অবস্থানে রয়েছে সে প্রশ্ন উঠে আসছে বার বার।
নারী আজও পরিবার ও সমাজের প্রতি স্তরে বৈষম্য ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। এমনকি আমাদের সংবিধানে ‘সর্বস্তরে নারী-পুরুষের সমান অধিকার’ এবং ‘জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে মহিলাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার ব্যবস্থা গ্রহণ’ করার অঙ্গীকার থাকলেও ব্যক্তিস্বাধীনতা, নিরাপত্তা, নাগরিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক অধিকারের ক্ষেত্রে নারী বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। বাংলাদেশে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন-বিষয়ক প্রায় ১৫টি আইন ও যৌন হয়রানি নিরোধক নীতিমালা এবং এ বিষয়ে প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন সূত্রমতে নারী ও শিশু নির্যাতন আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
এ বিষয় বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ সম্পাদিত নারী নির্যাতনেরর বছরওয়ারি পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সমাজে নানা ক্ষেত্রে অগ্রগতি ঘটলেও একই হারে নারী ও কন্যাশিশুর উপর নির্যাতন ও অনাচারের যে ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে তা রীতিমত হতবাক করে দিচ্ছে।
এতে দেখা যায়, গত ২০১৫ সালে দেশে ৪ হাজার ৪৩৬টি নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। যার মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ১ হাজার ৭ জন নারী। এর মধ্যে গণধর্ষণের শিকার ১৯৯ জন। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৮৫ জনকে। পাশাপাশি ধর্ষণের চেষ্টা হয়েছে ১৪২ জনের। শ্লীলতাহানীর ঘটনা ঘটেছে ১০৩টি। বিভিন্নভাবে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৬৮ জন নারী।
একই সময়ে নারীর প্রতি অন্যান্য সহিংস ঘটনার মধ্যে রয়েছে- এসিডে দগ্ধ ৩৭ জন, অপহরণ ৯৭ জন, পাচার ৪৭ জন, পতিতালয়ে বিক্রি ১৮ জন, যৌতুকের কারণে হত্যা ২০৩ জন, যৌতুকের কারণে নির্যাতন ১৮৩ জন, বাল্যবিবাহ ৯৪ জন, গৃহপরিচায়িকা নির্যাতন ৩৭ জন, গৃহ পরিচায়িকা হত্যা ৩০ জন, রহস্যজনক মৃত্যু ১৬৭ জন ইত্যাদি।
এদিকে ২০১৬ সালের হিসেবে জানুয়ারি থেকে ফেব্রুয়ারি নাগাদ নারী নির্যাতনে এ সংখ্যা হয়েছে ৮২৭টি। যার মধ্যে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ১৩৫টি এবং গণধর্ষণ হয়েছে ১৪ জন নারী।
এগুলো শুধু সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে মহিলা পরিষদ নারী নির্যাতন সংক্রান্ত বছরওয়ারি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তবে প্রকৃত সংখ্যা এর চেয়ে অনেক বেশি। কারণ নারী নির্যাতনের বেশির ভাগ ঘটনাই অপ্রকাশিত থাকে।
এ পরিপেক্ষিতে এ বছরের আন্তর্জাতিক নারী দিবসের প্রতিপাদ্য অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশে নারী-পুরুষের পরিপূর্ণ মর্যাদা ও সাম্যতা অর্জন অর্থাৎ ৫০: ৫০ লিঙ্গসমতা অর্জনের প্রত্যাশা কতটা যৌক্তিক তা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে সচেতন মহলে।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, আইনের যথাযথ প্রয়োগের পাশাপাশি সমাজের সচেতনতা ও নৈতিক মূল্যবোধের উন্নয়ন ঘটাতে হবে। পরিবার থেকেই শুরু করতে হবে নারীর প্রতি সম্মান প্রদর্শনের শিক্ষা। কারণ কোনো সমাজে মানুষ নৈতিকতা বিবর্জিত হলে নারীর অনিরাপদ থাকা স্বাভাবিক।
পাশাপাশি নারীকে সুরক্ষা দিতে হলে বিদ্যমান আইন বাস্তবায়নের পাশাপাশি এ অবস্থার উত্তরণ ঘটাতে নারীর ক্ষমতায়ন দরকার। ক্ষমতায়ন ও নারীর সম-অধিকার নিশ্চিত করতে পারলে নিরাপত্তাহীনতাও কেটে যাবে।
এ বিষয়ে একজন নারী অধিকার কর্মী বলেন, দেশে নারী কতটা অনিরাপদ! তার বহিঃপ্রকাশ ঘটছে নির্যাতনের এই রিপোর্টের মাধ্যমে। তিনি বলেন, তবে যেসব নারী তাদের নিজ পরিবারে নির্যাতনের শিকার হয়, সেগুলো তারা প্রকাশ না করা পর্যন্ত কেউ জানতে পারে না। ফলে কোনো সংগঠনই এই নির্যাতনের চিত্র সঠিকভাবে তুলে ধরতে পারে না।
তিনি আরও বলেন, এসব নির্য়াতন থেকে নারীকে বাঁচাতে হলে শুধু আইন করেই হবে না, সার্বিক নৈতিকতাবোধের উন্নয়ন ঘটাতে হবে। নারীকে শুধু পণ্য হিসেবে দেখানো বন্ধ করতে হবে। এক্ষেত্রে নারীদের ভূমিকাও কম নয়। তাদেরও নিজেদের সম্মান নিজেরা বুঝে চলা শিখতে হবে। তবেই নারী পুরুষ ৫০:৫০ অবস্থান কল্পনা থেকে বাস্তবে রূপ নেওয়া সম্ভব হতে পারে।
Visits: 7