বিয়ের অনুষ্ঠান নাকি গলার ফাসঁ??
আমরা গ্রামে বেড়াতে এসেছি । ছেলে মেয়ের স্কুল ছুটি , গ্রীষ্মকালীন অবকাশ তার সাখে গ্রামের এক আত্মীয়ের বিয়ে । আমার Husband-এর খালাতো বোনের ছেলের বিয়ে । আমরা ঢাকা থেকে বিয়ের আগের দিন সকালে রওয়ানা দিয়ে বিকেল চারটায় এসে পৌঁছেছি । ও…..আমাদের গ্রামের বাড়ির লোকেশনটাই তো বলা হলনা…….আমাদের গ্রামের বাড়ি রাজশাহী জেলার একটি গ্রামে । আর রাজশাহী মানেই তো অনেক গরম…..এই গরমে যদি ও আমাদের কষ্ট হয়েছে তারপরেও আমরা এসেছি কারণ একমাত্র ভাগ্নে বলে কথা ।
আমরা বিয়ের দিন সকাল ১১ টার একটু পরে রওয়ানা হলাম । ভাগ্যক্রমে একটি সি.এন.জি পাওয়াতে ছেলে মেয়ে নিয়ে এই রোদের মধ্যে একটু আরামেই যেতে পারলাম । প্রায় ৪০ মিনিট যাওয়ার পরে আমরা গেট বাঁধানো একটি বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালাম । বুঝা গেল এটাই সেই কাঙ্খিত বিয়ে বাড়ি । বাড়ির বাইরে বেশ খানিকটা খোলা জায়গা সেখানে খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে । সদর দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকলাম দেখি ভিতরে ও বেশ বড় উঠান । সেখানেও খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে । বাইরে বরযাত্রী দের জন্য আর ভিতরে বাড়ির আত্মীয় স্বজনদের জন্য ।
বাড়িটার চারদিকেই টিনের ছাউনি দেয়া। দুই দিকে দুটি দুটি করে মোট চারটি ঘর আর একদিকে কোণায় টিউবওয়েল , বাথরুম, টয়লেট একই সাইডে একটু সরে এসে রান্নার জায়গা । বাকি একদিকে খোলা বারান্দার মতো কোন এক সময় হয়তোবা এখানে গরু রাখা হতো , এখন নেই । বাড়ির কর্তা যে অনুপস্থিত তা বাড়ির চেহারা দেখলেই বুঝা যাচ্ছে , সবকিছু ছন্নছাড়া । মেয়ের বাবা প্রায় এক বৎসর আগে এই ধরাধাম ত্যাগ করেছেন । তিনি একটি স্কুলের শিক্ষক ছিলেন । এক ছেলে আর এক মেয়ে । মেয়ে বড় । জাতীয় বিশ্ব বিদ্যালয় থেকে অনার্স কমপ্লিট করেছে । ছোট ছেলে সরকারি কোন্ এক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ব বিদ্যালয়ে পড়ে । ও আমাদের পাত্রের পরিচয় টা তো দেওয়া হলোনা ….পাত্র ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার । একটা প্রাইভেট ফার্মে চাকরি করে , পাশাপাশি বি. এস. সি. ও করছে ।
আমাদেরকে বৌ এর ঘরে নিয়ে বসানো হলো । বৌ মোটামুটি ভাল । ওর গায়ে অনেক সোনার অলংকার ঝিকঝিক করছিল । মেয়ের বাড়ি থেকে নাকি দশ ভরি সোনার গহনা দিয়েছে । সোনার যা বাজার , দশ ভরি সোনার গহনা , যেখানে বাবা বেঁচে নেই …..একটু বেশি ই মনে হল । পরক্ষণেই মনে হল ….দেয়ার সামর্থ্য আছে বলেই দিয়েছে , আমার এইসব ফালতু বিষয় চিন্তা করে লাভ নেই ।
তাই আমি নতুন বৌয়ের সাথে পরিচিত হওয়ার জন্য গল্প গুজব শুরু করলাম । তাকে কে সাজিয়েছে জিজ্ঞাসা করতেই বলল: আমি পার্লার থেকে সেজে এসেছি ।আমি বললাম : তোমাদের এখানে কাছাকাছি কোথাও কি পার্লার আছে?? সে বলল : আমি রাজশাহী থেকে সেজে এসেছি । আমি অবাক হয়ে বললাম : এতদূর রাজশাহীতে (প্রায় ৬০/৬৫ কি.মি .হবে ) যেয়ে সেজে এসেছ ? কীভাবে ?? সে বলল : আমি একদম ভোরে গিয়েছি আর একটু আগেই এসেছি । আমি বললাম: বাহ! খুব ভালো! সাজতে হলে ভাল জায়গাতেই সাজতে হবে ।
কিন্তু মনের ভিতরে কি যেন একটা খচ খচ করতে লাগল. …” এরা এত ঘটা করে বিয়ের আয়োজন করছে এদের তো মাথার উপরে কেউ নেই । বৌ এর মা , উনি একা কয়দিক সামলাবেনন ?? আর আছে ছোট ভাই সে তো বৌ এর বেশ ছোট মাত্র অনার্স ফার্সট ইয়ারে পড়ে , সেইবা কি করবে? অনেক মানুষ জন দাওয়াত করেছে । পারবে তো এরা সামাল দিতে?? এইসব বিভিন্ন চিন্তা মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল ……আবারো নিজেকে শান্ত করলাম এই বলে যে , দেখা যাক কি হয় ??
এর মধ্যে আবার দুই জন ভিডিওম্যান দুই দিক থেকে পুরো বিয়ের অনুষ্ঠানটাকে ভিডিও করছে । নাহ! গ্রাম হিসেবে বেশ এলাহী কান্ড । বৌ এর সাথে কথাটথা বলে , আমার মেয়ের সাথে বৌ এর কয়েকটি ছবি নিয়ে, আরো কিছুক্ষণ বসে , মেয়ে যখন আর ভিড়ের মধ্যে থাকতে চাইলনা তখন তাকে নিয়ে বের হয়ে পাশের রুমে আসলাম । এই রুমে একটু ভিড় কম । এমনিতেই গরম তার উপরে বিদ্যুত্ বিভ্রাট । ফ্যানগুলোর স্পিড ও অত্যন্ত কম তার উপরে সেগুলোর নীচে জনগণের কোন কমতি নেই । ঐ দিকে আর না যেয়ে একটি হাত পাখা খুঁজে নিয়ে সেটা দিয়ে ই মেয়েকে বাতাস করতে লাগলাম ।
একটু পরে দেখি বাইরে দুই তিনজন ধরাধরি করে বারান্দায় ফ্যানের নীচে বৌ এর ভাইকে নিয়ে এসে বসাচ্ছে । কি হয়েছে জিজ্ঞাসা করতেই বলল এত গরমে ছোটাছুটি করে অসুস্থ হয়ে পড়েছে । সবাই মিলে মাথায় পানি দিয়ে , বাতাস করে একটু পরে সে কিছুটা সুস্থ হল ।
এদিকে ঘড়ির কাঁটা ৩টার ঘর পাড় হয়ে যাচ্ছে তবু বরযাত্রীদের খাবার দেয়ার কোনও নাম নেই । পরে শুনা গেল খাবার যা রান্না করা হয়েছিল তা শেষ আবার নতুন করে রান্না করতে হবে । ঐ দিকে আবার আরেক ঘটনা ……. মেয়ের কলেজ থেকে আসা বন্ধু বান্ধবীর দল যাদেরকে দেখে বেশ ধনীর দুলাল দুলালী (নাকি ভাব !! ) মনে হচ্ছিল তারা পাততাড়ি গোটাতে লাগল ।কার যেন অসুস্থতার অজুহাতে এরা ঝটপট বিদায় নিয়ে কেটে পড়ল । সাথে সাথে আমার দুধের মাছির কথা মনে পড়ে গেল…. যারা শুধু সু সময়েই বন্ধুর কাছে থাকে আর দুঃসময় দেখলেই দ্রুত লেজ গুটিয়ে পালায়….. মেয়েটি এতক্ষণ ধরে কাঁদেনি .. সাজ নষ্ট হওয়ার ভয়ে …..এবার সে কেঁদে ফেলল….। মেয়েটির অসহায়ত্ব দেখে আমারও কেমন যেন অসহায় লাগতে লাগল….।
এর কিছুক্ষণ পরে দেখা গেল মেয়ের মা অসুস্থ হয়ে পড়েছে । কয়েকজন ধরাধরি করে মেয়ের মাকে নিয়ে এসে খাটে ফ্যানের নীচে শুইয়ে দিল । সেবা শুশ্রূষা করার পর তিনি কিছুটা সুস্থ বোধ করতেই আপন মনে বিলাপ শুরু করলেন …..হায় হায় রে……আমি এখন কি করব?? আমার স্বামী নাই আমার আগেই বুঝা উচিত ছিল ….. আমার এতকিছু করা ঠিক হয়নি …. ও মণি আমি তোরে যে সাত হাজার টাকা দিয়েছিলাম পার্লারের জন্য সেখান থেকে কি কোন টাকা বাঁচে নি ?? ইত্যাদি ……ইত্যাদি …….
বিকাল চারটার ও পরে আমাদের খেতে দিল… এমনিতেই গরম তারপর এতসব ঘটনায় কারো আর খাওয়ার রুচি বলে কিছু বাকি ছিলনা ….।
চলে আসার আগ দিয়ে মেয়ের মায়ের কাছে বিদায় নিতে যেয়ে যেইনা বললাম : আপনি কোন চিন্তা করবেন না…… সব ঠিক হয়ে যাবে …. আল্লাহর উপর ভরসা করুন……..অমনি তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললেন ।
ফিরে আসার সময় গাড়িতে বসে বার বার এইসব দৃশ্যই চোখের মধ্যে ভাসছিল…..সত্যি ! আমাদের দেশে বিয়ের অনুষ্ঠান মানেই যেন সাধ্যের অতিরিক্ত কিছু করা । সমাজের প্রচলিত নিয়ম কানুন পালণের নামে , সমাজের মানুষের কাছে নিজেদের বড় করে দেখানোর জন্য …. কিংবা …নিজেদের শখ মেটানোর নামে এরা এমন কিছু করে যা তাদেরকে আনন্দ দেয়ার বদলে দুশ্চিন্তায়ই রাখে বেশি …..
শুধু অভিভাবকদেরই যে দোষ তা কিন্তু নয় । কিছু কিছু পরিবারের সন্তানেরা যারা বাইরে থেকে পড়াশুনা করে ওরা অনেকেই তথাকথিত বড়লোকদের সন্তানেরা যারা বেহিসাবি টাকা – পয়সা খরচ করে তাদের সাথে চলাফেরা শুরু করে….. আর তাদের দেখাদেখি নিজের বাবা-মায়ের আর্থিক অবস্থা বিবেচনা না করেই ঐ সময়ও যেমন বেশি টাকা দেয়ার জন্য চাপ দেয় ……তেমনি বিয়ের পিড়িঁতে বসলেতো কথাই নেই ……এইসব তথাকথিত বড়লোক বন্ধু- বান্ধবী যারা ধরাকে সরা জ্ঞান করে তাদের মনোতুষ্টির জন্য এমন কিছু নেই যা করেনা…।
যতবার বৌ এর মা আর ভাইয়ের করুণ চাহনি মনে পড়ছে ততবার খারাপ লাগছে….উহ!! যেন বিয়ের অনুষ্ঠান নয় … .একেকটি গলার ফাঁস …..
অথচ যার যেমন সামর্থ্য সে অনুযায়ী অ্যারেন্জ করলে বিয়ের অনুষ্ঠান হয়ে উঠে প্রকৃত আনন্দময় ।।
Visits: 4