পরিবর্তন হচ্ছে আরো হবে…
ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছি আমাদের পুরান ঢাকায় শবে বরাত দিনটা পাঁচভাবে উদযাপন করা হয়।
১/ পটকাবাজি করে।
২/ আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে হালুয়া-রুটি বিতরণ করে।
৩/ নতুন জামা কিনে।
৪/ ঘরের মহিলা (বিশেষ করে বয়ষ্ক/ মা’ গোছের) ও মসজিদে মসজিদে রাত জেগে ইবাদত ও জিকির।
৫/ মসজিদে আলোকসজ্জা করে।
তবে আনন্দের বিষয় হলো- উপরের পাঁচটি বিষয়ের মধ্যে দু-তিনটিতে সমাজের মানুষের মধ্যে সচেতনতা বেড়েছে। এটা শুভ লক্ষণ। যেমন ছোটবেলায় আপনজন- প্রতিবেশী, পুরো এলাকায় যেভাবে বোমা, পটকা, আতশবাজির শব্দ শোনা যেতো-এখন মানুষের সচেতনতার কারণে অনেক কমে গেছে। উল্লেখ্য, আমাদের আপনের মধ্যেই দেখা গেছে শবে বরাতের বোমা ফুটাতে গিয়ে হাতের কব্জিই উড়ে যায়। যাই হোক, আলহামদুলিল্লা আলেম সমাজ থেকে শুরু করে সচেতন মা-বাবাদের ধন্যবাদ জানাতেই হয়- তাদের সন্তানদের ভালো শিক্ষা দেয়ার জন্য। তাছাড়া এ দিনকে ঘিরে পটকাবাজি নামক বিকৃত সংস্কৃতির বিরুদ্ধে গত শুক্রুবারেও মসজিদে খুতবা দিতে দেখা গেছে।
এবার আসি দ্বিতীয় সচেতনতায়। ব্যাপারটা নিজ থেকেই বলি। ছোট বেলায় এ দিনটি উপলক্ষ্যে যেভাবে জামা নেয়ার একটা প্রচলন দেখতাম, বর্তমানে সেরূপ কুসংস্কৃতি (মানে, শবে বরাত আসলে জামা বানাতেই হবে) দেখছি না। মোদ্দাকথা, জামা লাগলে যেকোনো দিন বানাতে পারেন কিন্তু তাই বলে এ দিনে নতুন জামা নিতেই হবে এমন কোনো শর্ত নেই। যাই হোক- সমাজের সচেতন হওয়ার এটাও একটা নজির যে, এসব বদ্ধ ধারণার পরিবর্তন হচ্ছে।
উপরে দুটা সচেতনতা ও সমাজ পরিবর্তনের কথা বললেও আরো কিছু বিষয় পরিবর্তনের দাবি রাখে।
মসজিদে আলোকসজ্জা- মানুষ খুশির দিনে নিজ বাসায় আলোকসজ্জা করে থাকে। কিন্তু আমরা জানি, শাবান মাস হচ্ছে বেশি করে ইবাদতের মাস। কারণ সহিহ হাদিস দ্বারাই প্রমাণিত রমজান মাস ছাড়া এই শাবান মাসেই নবীজী মুহাম্মাদ সাঃ বেশি করে ইবাদত ও রোজা রাখতেন। যেহেতু এটা রমজানের আগের মাস তাই, রমজানের পূর্ব-প্রস্তুতির জন্য তিনি তাগিদ দিয়েছেন। আর সেই সাথে এই মাসের শেষ দিকে মানে ২৮,২৯,৩০ তারিখ রোজা না রাখতেও বলেছেন- যাতে আল্লাহ’র বান্দারা রমজানের আগেই বেশি ক্লান্ত না হয়ে পড়ে। সে যাই হোক- এগুলো হচ্ছে সুন্নত ও নফল ইবাদত। তবে কথা হলো- কিসের জন্য মসজিদে আলোকসজ্জা হচ্ছে? বরঞ্চ মসজিদের দানের টাকাটা কি আরো উন্নয়নমূলক কাজে ব্যবহার করা যেতো না? মাদ্রাসার কল্যাণে কাজে লাগানো যেতো না? এই আলোকসজ্জায় অপচয় করে কি লাভ হচ্ছে ইসলামের? প্রাকৃতিক সম্পদ অপচয় ছাড়া?
এদিকে লক্ষ্য করে দেখা যায়- মসজিদ থেকে ফজরের পরে মুসল্লিদের উদ্দেশ্যে পোলাও বিতরণ করা হয়। তা মসজিদ থেকে গরিব, মিসকিন কিংবা সর্ব-সাধারণের জন্য খাবার বিতরণে সমস্যা দেখি না। তবে শবে বরাতকে কেন্দ্র করে পোলাও দেয়ার মধ্যে আমি যুক্তি দেখি না। বরঞ্চ লক্ষ্য করা যায়- যারা মসজিদে যাওয়া তো দূর, ঘরেও ঠিক মতো নামাজ পড়ে না তারা পোলাও নেয়ার লোভে শবে বরাতের রাতে ফজরের নামাজ পড়তে আগে বাগে মসজিদে গিয়ে নিজের জায়গা ঠিক করে। সুতরাং, হচ্ছেটা কি! এক ওয়াক্তের মুসল্লি বানানোর প্রশিক্ষণ?
অপরদিকে, ছোটবেলায় শুনেছে- (সহিস হাদিসের বর্ণনা জানি না) এই দিনে রাসূলুল্লাহ সাঃ এর দাঁত শহীদ হয়েছিলো, এরপর উনার জন্য মদিনাবাসীরা মিষ্টি জাতীয় তথা হালুয়া রান্না করেছিলেন। সেই থেকে নাকি শবে বরাত উপলক্ষ্যে হালুয়া-রুটির প্রচলন। তবে আমি কোথাও পড়ি নি যে, এই দিনে এসব রান্না করতে নবীজী বাধ্য করেছেন কিনা, তবে মিডিয়ায় প্রচারণা তো আছেই সেই সাথে অনেকেই দেখি- কিছু হোক বা না হোক হালুয়া বানানোটা ফরজের মতো পালন করেন। কথা হলো- যেকোনো দিন আমরা হালুয়া-রুটি হোক বা ভিন্ন কিছু একে অপরের বাসায় পাঠাতেই পারি- এতে সম্পর্ক বাড়ে, তবে এই দিনেই করতে হবে, এমন তো নয়। বরং অনেককে এ কাজে বাড়াবাড়ি করতে দেখি; সেই সাথে অপচয় হতেও দেখি। বাস্তবিক উদাহরণ দেই- বিভিন্ন দোকানে বড় বড় নকশা করা রুটি বানিয়ে বিক্রি করা হয়, তবে সেসব রুটি কিছুটা শক্ত প্রকৃতির হয়, আর বেশি খাওয়াও যায় না। ফলে অপচয় হয়।
সবশেষে বলতে, সচেতনতার কারণে যেমন কিছু কুসংস্কৃতি দূর হচ্ছে, সেই হিসাবে আরো কিছু অহেতুক, উদ্দেশ্যহীন ও অপচয়মূলক সংস্কৃতি- বিশেষ করে যা ধর্মের নামে চলছে- সেগুলো দূর করতে আমাদের সচেতনতা প্রয়োজন।
Visits: 1