গৌতম বুদ্ধ রোগী, মৃতদেহ, বৃদ্ধ ও সন্ন্যাসী-এই চার শ্রেণীর কষ্ট দেখে রাজ প্রাসাদ ছেড়েছিলেন, সংসার ছেড়েছিলেন। সিদ্ধি লাভের আসায় পথে পথে ঘুরলেন, উপলদ্ধি করলেন এবং একদিন তিনি বললেন, ‘মা যেমন নিজের শিশুকে রক্ষা করে, প্রত্যেকের উচিৎ প্রত্যেক প্রাণীকে তেমনি ভালোবেসে বিপদ থেকে রক্ষা করা।’
জাতিসংঘের মতে পৃথিবীতে সবচেয়ে নির্যাতিত সংখ্যালঘু জাতি হচ্ছে রোহিঙ্গা, যাদের কোন দেশ নেই, রাষ্ট্রীয় পরিচয় নেই। বুদ্ধের অনুসারিদের দ্বারা প্রতিনিয়ত হত্যা, নির্যাতনের স্বীকার। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বসবাসকারি এই সংখ্যালঘুদের ১৯৮২ সালে বার্মা সরকার বললো ‘তোমরা বার্মার নাগরিক নও! তোমরা বৃটিশ রাজত্বকালে এদেশে এসেছো বাংলাদেশ থেকে’! সেই উনবিংশ শতকের শুরুর দিকে বৃটিশরা আরাকানকে তাদের শাসনাধীন আনে। এরপর গেছে উনবিংশ শতাব্দি, বিংশ শতাব্দি, এখন চলে একবিংশ শতাব্দি। এরমধ্যে তাদের কয়েকটি প্রজন্ম গত হয়েছে। যে মাটিতে মিশেছে তাদের সেই পুর্ব পুরুষদের মৃতদেহ সেই মাটি আজও তাদের হয়নি, সরকারি ঘোষণা এসেছে ‘তোমরা এদেশে অবৈধ, মানে তোমাদের এদেশ ছাড়তে হবে।’
১৭৯৯ সালের লেখা এক বইয়ে বুকানন হ্যমিল্টন আরাকানে বসবাসরত মুসলিমদের ‘রয়িঙ্গা’ নামে উল্লেখ করেছেন। রোহিঙ্গাদের নিজেদেরও দাবী তাই, ‘আমরা শতাব্দির পর শতাব্দি এখানে বসবাস করে আসছি।’ মায়ানমার বলছে ভিন্ন ইতিহাসের কথা, ‘তারা বৃটিশ রাজত্বকালে এদেশে এসেছে।’ ইতিহাস নিয়ে সব সময়ই বিতর্ক করার সুযোগ থাকে। কিন্তু একটি স্থানে কমপক্ষে কত শত বছর বসবাস করলে সেখানকার স্থায়ী বাসিন্দা বলে স্বীকৃতি পাওয়া যায়?
তাদের রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব নেয়, তাই সরকারি কোন চাকরির সুযোগ নেই, জমির মালিকানা নেই। কৃষিজীবী এই জনগোষ্ঠীর সন্তানেরা পিতামাতার জমির উত্তরাধিকার পায়না। একটির বেশি সন্তান নিতে পারেনা। এই নিয়মগুলো শুধুমাত্র বার্মার আট লক্ষ রহিঙ্গা সংখ্যালঘু মুসলমানদের জন্য। একই পাড়াই, হয়তো খুবই নিকট প্রতিবেশি বৌদ্ধদের এই সব অধিকারগুলো আছে। শুধু তাদের ক্ষেত্রেই রয়েছে রাষ্ট্রারোপিত কঠোর কঠোর বিধান। এরপর আছে নিয়মিত বিরতিতে বুদ্ধের অনুসারিদের হামলা, ঘরবাড়ি জ্বালানো, হত্যা, ধর্ষণ। এই গণহত্যা থেকে বাচতে যুগ যুগ ধরে ভাঙ্গা নৌকায় শত শত মাইল পাড়ি দিয়ে আশ্রয় লাভের চেষ্টা করেছে, কখনো বাংলাদেশে, কখনো মালয়শিয়ায়, কখনো থাইল্যান্ডে।
পৃথিবী থেকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে মানুষ কেনাবেচা বিলুপ্তি ঘটেছে কয়েকশত বছর আগে। তারপরও জাতিসংঘের দেওয়া তথ্যমতে বর্তমানে সর্ববৃহত অবৈধ ব্যবসা মাদক নয়, মানব পাচার। অত্যাচার, নির্যাতন, বঞ্চনা ও দরিদ্রতার স্বীকার জনগোষ্ঠীকেই এই পাচারকারীরা টার্গেট করে। তারা আজ টার্গেট করেছে রহিঙ্গাদের এবং কয়েক বছরের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে যাওয়া বাংলাদেশের নাগরিকদের। সমাজ, রাষ্ট্রের অনাচারের স্বীকার অনেকের কাছে অবৈধ এই জনগোষ্ঠীর আজ ঠায় হয়েছে সাগরের বুকে।
নিজের রাজ্য থেকে বের হয়ে এসে বিহারের বুদ্ধগোয়ায় ফল্গু নদীর তীরে বটগাছের নিচে দীর্ঘ ছয় বছর অর্ধাহারে থেকে তপস্যা শেষে গৌতম বুদ্ধ নিজের শরীর সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন,
“আমার শরীর দুর্বলতার চরম সীমায় পৌছেছিল। অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো বৃদ্ধের ন্যায় ঝুলে পড়েছিল। পৃষ্ঠদেশ উচুনিচু হয়ে উঠেছিল। চক্ষু কোটারোগত হয়েছিল, চামড়া শুকনো লাউয়েরমত দেখাচ্ছিল। আমার গৌর বর্ণের শরীর কৃষ্ণ বর্ণ ধারণ করেছিল।”
আমি আজকে বৌদ্ধ মন্দিরগুলোতে এই বুদ্ধকে খুজে পাই না। আমি দেখি, হাজার হাজার বুদ্ধ সাগরের বুকে ভেসে বেড়াচ্ছে, প্রাণপনে চেষ্টা করছে তীরে ফিরতে, আর মন্দিরগুলো থেকে বিশেষ পোষাকে তকতকে চেহারার মানুষগুলো তাদের তাড়িয়ে দিচ্ছে বোধসত্ত্ব লাভের আশায়!!!
Hits: 5