নিঃসঙ্গ জীবনে চাঁদের আলো…

0 ৫৯

পিয়ালকে প্রতিদিন সাগরের তীর ঘেঁষে বাসে করে ইউনিভার্সিটিতে যেতে হয়। যাত্রাপথে সে বসে বসে একাকী ভাবে ঋতু বৈচিত্রের মত বন্ধুত্ব, ভালোবাসার সম্পর্কের এতো রূপ বদল হয় কেন?! শৈশব থেকে আমি যাকে চিনেছি, জেনেছি, বিশ্বাস করেছি, বন্ধুত্বের বাঁধনে মন প্রাণ উজাড় করে ভালোবেসেছি, সুখ দুঃখ ভাগাভাগি করে এক সাথে কাটিয়েছি অনেকগুলো বছর, জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ অন্ধকার সময়ে অকৃত্রিম বন্ধুত্বের টানে আমরা সবসময় ছিলাম দুজন দুজনার শুভাকাঙ্ক্ষী হয়ে। অথচ আজ সে যেন আমার কাছে অজানা কেউ। একেবারেই অপরিচিত জগতের একজন। ভাবনাগুলো কেমন যেন এলোমেলো করে দেয় পিয়ালকে।

পড়ালেখার জন্য বিদেশে আসার পর থেকে পিয়ালের কত সকাল, কত সন্ধ্যা আর কত রাত কেটেছে অধীর প্রতীক্ষায় সেই প্রত্যাশিত বন্ধুর খোঁজে। কিন্তু মেলেনি তার উত্তর, সঙ্গসুখ কিংবা এতটুকু অন্তরঙ্গতা। একটু ভালোবাসা আর নিখাদ উষ্ণ বন্ধুত্বের স্পর্শের জন্য সে কতই না হাহাকার করেছে শুভ্রর জন্য!

অথচ কাকতালীয়ভাবে একদিন আবিষ্কৃত হল শুভ্র একই ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে। আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে উঠে পিয়াল। কিন্তু একি! পিয়ালকে শুভ্র কোন পাত্তাই দিচ্ছে না। একই ভার্সিটিতে লেখাপড়া করলেও প্রায় সময়ই পিয়ালকে দেখেও না দেখার ভান করে পাশ কাটিয়ে দ্রুত চলে যায় শুভ্র। তার এই আচরণের কী হেতু আজও জানে না পিয়াল! অনেকবার জানার চেষ্টা করেছে কিন্তু কোন সুফল বয়ে আনেনি তাতে।

মানুষ এতো নির্দয় হয় কেন? গভীর আক্ষেপের সুরে পিয়াল বলে উঠে, জীবনের পথে পথে শুধুই সাক্ষাৎ পেয়েছি স্বার্থপর আর লোভী মানুষ। যারা নিখাদ বন্ধুত্ব কিংবা সুখসঙ্গ দান নয়, প্রলুব্ধ হয় স্বার্থের মোহে। ব্যক্তিস্বার্থ আর লোভ ছাড়া সম্পর্কের মধ্যে আর কিছুই যেন অবশিষ্ট নেই মানুষের জীবনে। কেন এরকম হয় আমি জানিনা জীবনে আমি যাদেরকে বেশী ভালোবেসেছি তারাই আমাকে পর করে দিয়েছে অপ্রত্যাশিতভাবে,কিন্তু কেন?!

পিয়াল এক বুক কষ্ট নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে আর ভাবে, কেন এমন হয়? কেন মানুষ সবকিছুকে স্বার্থের নিক্তিতে পরিমাপ করে? আমার জীবনে কেন শুভ্র নেই অন্তরঙ্গ বন্ধু হয়ে, যার সঙ্গসুখে হয়তো আমি ভুলে যেতাম এত দিনের জমিয়ে রাখা নিঃসঙ্গতার সব বেদনা!

বিষণ্ণ মনে পিয়াল ক্লাস শেষে লাইব্রেরীতে বেশ কিছুক্ষণ কাটিয়ে যখন শিক্ষাঙ্গন থেকে বের হয়ে বাসে উঠলো জানালার কাঁচ দিয়ে হঠাৎ তার চোখ আটকিয়ে গেল আকাশের গাঁয়ে পূর্ণিমার অপরূপ চাঁদের দৃশ্যের পানে! শিহরণ জাগানো দৃশ্যে অভিভূত হয়ে সমুদ্র পাড়ে সে নেমে পড়লো একাকী। তৃষিত আঁখি অকল্পনীয় মুগ্ধতায় পলকহীনভাবে যতই দেখে ততই যেন তৃষ্ণা বাড়ে পিয়ালের।

অথচ কোনদিন ভাবেনি পিয়াল এই পূর্ণিমার চাঁদের কথা! আজ চাঁদের সৌন্দর্যের এই মুগ্ধতা তার চিন্তায় যেন সজোরে কড়া নাড়লো, হৃদয়ে পুষে রাখা সব কষ্ট মুছে দিয়ে, জমানো সব ভুল ভেঙ্গে দিয়ে প্রশান্তি এনে দিলো। পিয়াল ভাবলো, ধরিত্রী থেকে দূরে বহুদূরে সেই আকাশের চাঁদ! চাঁদের নিঃসঙ্গতার কাছে আমার নিঃসঙ্গতা তো কিছুই নয়। অথচ চাঁদ তো কারো সান্নিধ্য বা সুখসঙ্গ কখনও কামনা করে না! বরং তার উজাড় করা আলোয় গোটা পৃথিবী হচ্ছে আলোকিত এবং পুলকিত।

পূর্ণিমার চাঁদ হয়ে শুধুই অকৃপণভাবে পৃথিবীতে স্নিগ্ধ মায়াময় জোসনার আলো ছড়ায়। আর মানুষ কত দূর থেকে চাঁদের সেই সৌন্দর্যের সান্নিধ্য পাবার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠে, তার অপরূপ মুগ্ধতার সঙ্গ পেতে চায়। এই মধুময় সৌন্দর্যভরা রাতে পিয়াল চাঁদের পানে অনিঃশেষ ভালোলাগা নিয়ে তাকিয়ে থাকে। বিমুগ্ধ চিত্তে মহান স্রষ্টার অবিশ্বাস্য সৃষ্টি চাঁদকে নিয়ে কবিতা লিখে সে। কবিতার অন্তমিলের ফাঁকে ফাঁকে সমুদ্রের স্বচ্ছ জলের দর্পণে একবার চাঁদের ছবি দেখে আর একবার নিজের প্রতিবিম্ব দেখে মুগ্ধতায় শিহরিত হয়ে উঠে তার মন প্রাণ। চাঁদের অসীম সৌন্দর্য আর মিষ্টি জোসনায় যেন পিয়ালের হৃদয়াকাশ স্নাত হয়ে ভেসে যায় অন্য এক ভালোলাগার জগতে।

চাঁদের সৌন্দর্যের অকৃপণ দান, অপরূপ অনিঃশেষ স্নিগ্ধতা যেন পিয়ালের জীবনের সব না পাওয়ার কষ্ট, একাকীত্ব ও বেদনাময় নিঃসঙ্গতার সমাপ্তি রেখা টেনে দেয়, নিয়ে যায় তাকে অন্য এক প্রশান্তিময় জীবনের একমাত্র বন্ধু করে। পিয়ালের হৃদয়ে জন্ম নেয় মানবতার সেবায় নিজেকে বিলীন করার দৃঢ় প্রত্যয় ঠিক যেন চাঁদের মত করে। যে জগতে নেই কোন স্বার্থপরতা, অবিশ্বাস আর লোভী মানসিকতার প্রতিচ্ছবি কিংবা প্রতিবিম্ব। সেখানে শুধুই আছে মায়াবী চাঁদের মানবী আলো, নিঃস্বার্থ প্রগাঢ় ভালোবাসা আর প্রশান্তিময় বিশ্বাসের নিখাদ বন্ধন।

collected.

Visits: 5

মন্তব্য
Loading...