আমাদের সময়ের মসীহ

কুসংস্কার কারাগারের মত।প্রাথমিক পর্যায়ে মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে না পারলে ক্যান্সারের মত তা ছড়িয়ে পড়ে।সত্য আর মিথ্যার পার্থক্য বোঝাই তখন অসম্ভব হয়ে পড়ে।কুসংস্কারের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ হলো নিজের ধর্মকে অন্য সব ধর্মের চেয়ে শ্রেষ্ঠ মনে করা।কারো মত হিসেবে এটা হয়ত সহ্য করা যায়।কিন্তু চূড়ান্ত অনুসিদ্ধান্ত হিসেবে গ্রহণ করার কোন উপায় নেই।বর্তমান দুনিয়ায় সবচেয়ে বেশী অপপ্রচারের শিকার ইসলাম।অথচ অনুসারী সংখ্যার দিক থেকে খ্রিস্টান ধর্মের পর এটাই বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্ম।ইসলামে ধর্মান্তরিত হওয়ার সংখ্যাও অন্যান্য ধর্মের তুলনায় বেশী।

মধ্যপ্রাচ্য,উত্তর আফ্রিকা ও স্পেনে যখন ইসলামের প্রভাব বাড়ছিলো,তখন খ্রিস্টান অধ্যুষিত সাম্রাজ্যে ইসলাম নিয়ে কুসংস্কার ছড়াতে থাকে।জন্মভূমি থেকে ইসলামের উৎখাতে ব্যর্থ হয়েছিলো খ্রিস্টান ক্রুসেডাররা।কিন্তু এর প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদের বিরুদ্ধে তাদের বিষোদগার ছড়ানো বন্ধ হয়নি। আল কায়েদা ও তালেবানদের মত সশস্ত্র গ্রুপগুলো তাদের আরো সুযোগ করে দিয়েছে।২০০১ সালের ১১ নভেম্বর নিউ ইয়র্কের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার ও পেন্টাগনে হামলার ঘটনা ওই সব বিষোদগার ছড়ানো ব্যক্তিদের নতুন করে রসদ জোগায়।তখন থেকেই অমুসলিম বিশ্বে খুব পরিকল্পিতভাবে ইসলাম-বিদ্বেষ ও ইসলাম-ভীতি ছড়ানো হচ্ছে।

ইসলামবিরোধী সমালোচনার প্রধান দু’টি বিষয়ের একটি হলো ইসলামের প্রসার হয়েছে তলোয়ারের মাধ্যমে।দ্বিতীয়টি হলো এর প্রতিষ্ঠাতা নবীকে মুসলমানেরা যতটা পবিত্র ও গুণের আধার মনে করেন,তিনি ততটা পবিত্র নন।ঐতিহাসিক তথ্য-দলিল দিয়ে এটা প্রমাণ করা যায় যে,ইসলাম মানুষের উপর দেয়া হয়নি।লাখ লাখ মানুষ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেছে।কারণ ইসলামের মধ্যে তারা নতুন মূল্যবোধ,মৌলিক মানবিক সমতা এবং নারীর অধিকারের স্বীকৃতি পেয়েছে যেগুলো সমসাময়িক সময়ে কেউ এর আগে শোনেওনি।ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ার মত দেশগুলোতে কোন মুসলিম সেনাপতি আসেননি।এসব জায়গায় ইসলাম এসেছে মুসলিম মিশনারীদের মাধ্যমে।

মুসলমানেরা তাদের নবীর সমালোচনার ব্যাপারে খুবই স্পর্শকাতর।ফারসি ভাষায় একটা প্রবাদ আছেঃ ‘বা খুদা দিওয়ানা বাসো,বা মোহাম্মদ হুশিয়ার!’ অর্থ্যাৎ সৃষ্টকর্তার ব্যাপারে যা ইচ্ছে বলো,কিন্তু মোহাম্মদের ব্যাপারে কথা বলতে হুশিয়ার! মুসলমানরা তাদের নবীকে মনে করে এই পৃথিবীতে বিচরণকারী মানুষদের মধ্যে সর্বোত্তম।আদম,মুসা,নূহ,ইবরাহীম ও খ্রিস্টের উত্তরসূরী।নবীদের মধ্যে তিনি সর্বশেষ।

মুসলমানরা তাদের নবীকে কিভাবে দেখে,সেটা সত্যিই জানতে চাইলে তার জীবনযাপন ও রেখে যাওয়া আদর্শের মধ্য দিয়ে দেখতে হবে,যেটা তার মতে আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে।আলকায়েদা ও তালেবান আদর্শ কিংবা আয়াতুল্লাহ ও বোকাসোকা মোল্লাদের মওসুমি ফতোয়া দিয়ে তাকে বিচার করা ভুল হবে।

হিন্দুৎভার নাম দিয়ে যেসব হিন্দু মসজিদ ধ্বংস করেছে,মিশনারী ও নানদের হত্যা করছে,লাইব্রেরী ও শিল্পকল্প ধ্বংস করছে,তাদের দিয়ে নিশ্চয়ই আপনি বেদ বা উপনিষদের হিন্দুত্ববাদকে বিচার করবেননা।কিংবা জার্নালি সিং ভিন্দ্রানওয়ালী কী বললো,তার দস্যুবাহিনী কতজন নির্দোষ ব্যক্তিকে হত্যা করলো,তা দিয়েও আপনি শিখ গুরুদের শিক্ষাকে মূল্যায়ন করতে পারেননা।একইভাবে মোহাম্মদ (সাঃ) কে বিচার করুন তার আদর্শ ও কর্ম দিয়ে।তার তথাকথিত অনুসারীরা কি করছে,তা দিয়ে নয়।

মোহাম্মদ (সাঃ) জন্মগ্রহণ করেন মক্কায়,৫৭০ সালে।শিশুকালে মা ও বাবাকে হারান তিনি।বড় হন দাদা ও চাচার কাছে।এক বিধবার ব্যবসায় দেখাশোনা করেন তিনি।পরে তাকেই বিয়ে করেন।ঐ নারীর গর্ভে মোহাম্মদ (সাঃ) এর ছয় সন্তানের জন্ম হয়।তিনি জীবিত থাকতে মোহাম্মদ (সাঃ) আর বিয়ে করেননি।তার বয়স যখন ৪০,তখন পাহাড়ের গুহায় তার উপর প্রত্যাদেশ আসতে শুরু করে।মোহাম্মদ (সাঃ) কে ঘোষণা করা হয় নতুন মসীহ হিসেবে।এরকম ঐশীবাণী মাঝে মধ্যেই আসতে থাকে।কখনো সমসাময়িক বিষয় নিয়ে,কখনো আধ্যাত্বিক বিষয় নিয়ে।এই বাণীগুলো তার অনুসারীরা মুখস্হ করে নিতেন।যেগুলো পরে লিখিত রুপ নেয়।এর নামই কুরআন,যার অর্থ পাঠ করা।

একটা জিনিস মনে রাখা দরকার,মোহাম্মদ (সাঃ) তার নিজের কোন ধারণা প্রচার করেননি।বরং যে জিনিসগুলো ইহুদী বিশ্বাসের মধ্যে আগে থেকেই ছিলো,সেগুলোই নতুন করে তুলে আনেন তিনি।তার কাছে আল্লাহ হলো,সৃষ্টিকর্তারই আরবী রুপ।একইভাবে ইসলাম হলো ‘আত্মসমর্পণ’ আর সালাম হলো ‘শান্তি’। মক্কা ছিলো বেদুঈনদের প্রধান বাণিজ্যিক শহর।তারা কাবার কাছে একত্র হতেন দুইবার।বড় পরিসরে হজ্বে আর ছোট পরিসরে উমরাহের সময়।ইহুদী ঐতিহ্যের হালাল-হারামের অনেক জিনিস মোহাম্মদ (সাঃ) গ্রহণ করেছিলেন।যেমন শূকরের মাংস ছিলো হারাম।তাছাড়া পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের নাম ও পুরুষ শিশুদের খাতনার বিষয়টিও ইহুদী সংস্কৃতি থেকে নেয়া।

মোহাম্মদ (সাঃ) জোর দেন সৃষ্টিকর্তার একত্ববাদের উপর।যেখানে তার সমকক্ষ কিছু নেই।বিভিন্ন গোত্র যেসব পাথরের দেবদেবীর উপাসনা করতো,সেগুলোকে প্রত্যাখান করেন তিনি।মোহাম্মদ (সাঃ) কখনই মানুষকে তার বিশ্বাস গ্রহণের জন্য জোরজবরদস্তি করেননি।

এমনকি ধর্মবিশ্বাসের স্বাধীনতা নিয়ে আল্লাহর বাণীও শোনান তিনি।’বিশ্বাসের ব্যাপারে কোন জবরদস্তি নেই’-লা ইকরাহা ফিদ্দীন।’ আরো বললেন-’আর আল্লাহ যদি ইচ্ছা করতেন,তিনি তোমাদের সবাইকে তার বিশ্বাসের অধীন করে দিতেন।কিন্তু তিনি সেটা করেননি,কারণ তিনি তোমাদের পরীক্ষা করতে চান।এমনটাই ছিলো তার প্রতিশ্রুতি যাতে তোমরা ভালো কাজের প্রতিযোগিতা করতে পারো।

যেটা স্বাভাবিক ছিলো,সেটাই হলো।মোহাম্মদ (সাঃ) এর মিশন তীব্র প্রতিরোধের মুখোমুখি হলো।তাকে হত্যার জন্য অনেক চেষ্টা হলেও অলৌকিকভাবে তিনি বেঁচে যান।শেষ পর্যন্ত ৬২২ খ্রিস্টাব্দে মক্কা ছেড়ে মদিনা যাওয়ার জন্য বলা হয় তাকে।এটা পরিচিত হিজরা (অভিবাসন) নামে।এ সময় থেকেই মুসলিম ক্যালেন্ডার গণনা শুরু হয়।মক্কাবাসীরা মদীনা দখলের জন্য কয়েক দফা চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়।মোহাম্মদ (সাঃ) এর নেতৃত্বে মুসলিম বাহিনী বিজয়ী হয় এবং মক্কায় তারা ফিরে আসে বিজয়ীর বেশে। ৬৩২ খ্রিস্টাব্দে মোহাম্মদ (সাঃ) যখন মারা যান,তখন আরব উপদ্বীপের জনপদগুলো সংঘবদ্ধ হয়েছে।ইসলামের অধীনে সেখানে সহাবস্হান করছিলো বিভিন্ন গোত্রের মানুষ।

মোহাম্মদ (সাঃ) এর বিরুদ্ধে সমালোচনার লক্ষ্য হলো,প্রথম স্ত্রী খাদিজার মৃত্যুর পর তার একাধিক স্ত্রী গ্রহণের বিষয়টি।এটাকে দেখতে হবে তৎকালীন আরব সমাজের প্রেক্ষাপট থেকে।আরবের গোত্রগুলোর কাজ ছিলো একে অন্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা আর ক্যারাভান লুট করা।পুরুষদের মধ্যে তাই প্রচুর হতাহত হতো।স্বাভাবিকভাবেই পুরুষ ও নারীর অনুপাতের ফারাক ছিলো অনেক।বিধবা ও নিহত পুরুষদের সন্তান-সন্ততিদের আশ্রয়ের প্রয়োজন ছিলো।আশ্রয় না পেলে হয় তাদের বেশ্যাবৃত্তি অথবা ভিক্ষা করতে হতো।তাই বিয়ের মাধ্যমে তাদের আশ্রয় ও নিরাপত্তা দেয়া হতো।তা ছাড়া কোন নারীকে বিয়ের মাধ্যমে তার গোত্র ও বংশের মানুষদের কাছাকাছি যাওয়ার সুযোগ হতো।

আরবের মানুষের কাছে অগ্রহণযোগ্য কিছুই করেননি মোহাম্মদ (সাঃ)।বরং তিনি আরেকটু অগ্রসর হয়েছেন।তিনিই আরবের প্রথম ব্যক্তি যিনি ঘোষণা করেছেন,পুরুষের জন্য একটি বিয়েই উত্তম।একাধিক বিয়ের সংখ্যাটাকে তিনিই চারের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে দেন।সেখানেও শর্ত আছে,সব স্ত্রীকে সমানভাবে খুশী রাখতে পারলেই কেবল একাধিক স্ত্রী গ্রহণের অনুমতি রয়েছে।সহজ শর্ত নয় এটা।এ বিষয়ে কুরআনের বক্তব্য হলোঃ’এবং তোমার যদি ভয় হয় যে,এতিমদের প্রতি সমব্যবহার করতে পারবেনা,তবে অন্য নারী যারা তোমার জন্য বৈধ,তাদের মধ্যে থেকে দুই,তিন বা চারজনকে বিয়ে করো।কিন্তু তোমার যদি মনে হয়,তাদের সাথে সমতার আচরণ করতে পারবেনা,তবে একজনকেই বিয়ে করো।’ একটা বিষয় মাথায় রাখুন,ঐ সময়টাতে সারা দুনিয়াতেই পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্হায় বহুবিবাহ একটা স্বাভাবিক রীতি ছিলো।

মুসলিমবিরোধী কুসংস্কার থেকে মগজকে পরিস্কার করার প্রথম ধাপ হিসেবে আমি পরামর্শ দিবো কারেন আর্মস্ট্রংয়ের লেখা “মুহাম্মদঃ আ প্রফেট ফর আওয়ার টাইম” বইটি পড়ার জন্য।বর্তমান বিশ্বে তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের প্রধানতম লেখক আর্মস্ট্রং।তিনি একজন অমুসলিম।

মূল লেখকঃ খুশবন্ত সিং

অনুবাদকঃ জুলফিকার হায়দার।

২০০৮ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারী কলকাতার দ্য টেলিগ্রাফ পত্রিকায় এটি প্রকাশিত হয়।

Visits: 1

  • সাধারন
Comments (০)
Add Comment