রানি বিলকিস -১

কুরআনে বর্ণিত এক কিংবদন্তি নারী

0 ১০৬

আরব ইতিহাসের কিংবদন্তি নারী রানি বিলকিস। পবিত্র কোরআনের সুরা নামলে (২৯-৩৬ আয়াত) রানি বিলকিসের ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে। কোরআনের বর্ণনা থেকেও তাঁর মেধা, বিচক্ষণতা ও ক্ষমতার প্রতাপ সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। আল-কোরআনে বর্ণিত নারীদের মধ্যে রানি বিলকিসই সবচেয়ে পরাক্রমশালী। তিনি রাজত্ব করতেন আবর উপদ্বীপের বর্তমান ইয়েমেনে, প্রাচীন ইতিহাসে যা ‘সাবা’ নামে বিবৃত হয়েছে। ইসলামপূর্ব আরব ইতিহাসেও রানি বিলকিসের গৌরবোজ্জ্বল শাসনের বিবরণ পাওয়া যায়। তিনি ইয়েমেনের একটি বিস্তৃত অঞ্চল শাসন করতেন। তাঁর শাসনামলে ইয়েমেনের প্রভূত উন্নয়ন হয়। আর্থিক উন্নয়নের ফলে সুউচ্চ ভবন নির্মিত হয়। তাঁর মৃত্যুর পরও তা দীর্ঘকাল পর্যন্ত টিকে ছিল।

রানি বিলকিসের পূর্বপুরুষরা ইয়েমেনের সাবা অঞ্চল শাসন করতেন। তাঁর পূর্বপুরুষের নামানুসারেই এই অঞ্চলের নাম সাবা হয়। তাঁর বংশের নাম ছিল ‘শারাহ’। গ্রহণযোগ্য মতানুসারে বিলকিস ছিলেন জি-শারাহর কন্যা। যদিও কোনো কোনো ঐতিহাসিক বলেছেন, তাঁর পিতার নাম ইলি-শারাহ।

রানি বিলকিস সাবার রানি হওয়ার পর নারী হওয়ার কারণে গোত্রের লোকেরা তাঁর নেতৃত্ব মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানায়। তারা মেনে নিতে পারছিল না, একজন নারী তাদের ওপর কর্তৃত্ব করবে। ফলে তারা বিলকিসের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করল এবং ব্যাপক সেনা সমাবেশ ঘটাল। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে রানি তাঁর ভাইকে নিয়ে রাজপ্রাসাদ থেকে পালিয়ে যান এবং জাফর ইবনে কুরত আল আসাদির আশ্রয় নেন।

কিন্তু রাজ্য উদ্ধারের জন্য বিলকিস অভিনব এক কৌশল অবলম্বন করেন। তা হলো তিনি তাঁর প্রতিপক্ষ আমরের কাছে গেলেন, বিলকিস পালিয়ে আসার পর যিনি ক্ষমতা গ্রহণ করেছিলেন। আমর রানির সৌন্দর্যে মুগ্ধ হলেন এবং তাঁকে জীবনসঙ্গী করতে প্রলুব্ধ হলেন। রানিকে একত্রে মদপানের আমন্ত্রণ জানালেন। বিলকিস তাতে সাড়া দেন। আমর মদ পান করে নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়লে বিলকিস তাঁকে হত্যা করেন। কিন্তু আমরের লাশ লুকিয়ে রেখে তিনি রাজদরবারে যান এবং বলেন, ‘রাজা আমাকে বিয়ে করেছেন। তিনি সব শ্রেণির নাগরিককে অমুক স্থানে একত্র হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।’ যখন মানুষ নির্ধারিত স্থানে একত্র হলো, তিনি বললেন, ‘আমি রাজার স্ত্রী। তোমরা জানো তাঁর সন্তান জন্ম দেওয়ার ক্ষমতা নেই। তাই তিনি আমাকে উত্তরাধিকার নিযুক্ত করেছেন। তিনি আমাকে এ বিষয়ে তোমাদের অঙ্গীকার গ্রহণের নির্দেশও দিয়েছেন।’ লোকেরা বিলকিসের কথা বিশ্বাস করল এবং তাঁর হাতে বাইয়াত হলো। বাইয়াত শেষে তিনি জানালেন, রাজাকে খুন করা হয়েছে। কিন্তু আগেই তাঁর আনুগত্যের শপথ করায় তাদের কিছুই করার থাকল না। রাজত্ব স্থায়ী হওয়ার পর রানি বিলকিস সেনাবাহিনী পুনর্বিন্যাস করেন এবং একে একে হামির, ব্যাবিলন, নাহাউন্দা ও আজারবাইজান জয় করেন।

মারাব বাঁধের পুনর্নির্মাণকে রানি বিলকিসের অন্যতম সাফল্য মনে করা হয়, দীর্ঘ সময় অতিক্রান্ত হওয়ায় যা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। কোরআনে বর্ণিত রাজপ্রাসাদ রানি বিলকিসের অমর কীর্তি, হজরত সুলাইমান (আ.) যার বিবরণ শুনে মুগ্ধ হয়েছিলেন। রানি বিলকিসের ছিল একাধিক পুরুষ ও নারী দেহরক্ষী। এ ছাড়া তাঁর কাছে হামিরের ৩৬০ জন সম্মানিত নারী অবস্থান করতেন। কথিত আছে, রানি বিলকিস অভিজাত পরিবারের কন্যাদের নিজের কাছে রেখে লেখাপড়া ও শিষ্টাচার শেখাতেন। যখন তারা একটু বড় হয়ে উঠত, তখন তাদের সামনে পুরুষের গল্প করা হতো। গল্পের সময় যে মেয়ে মাথা নিচু করে ফেলত এবং তার চেহারার রং পরিবর্তন হয়ে যেত তাকে নিজ পরিবারে পাঠিয়ে দিতেন এবং সম্ভ্রান্ত পুরুষের সঙ্গে তার বিয়ের ব্যবস্থা করতেন। বিলকিস নিজেও ছিলেন অপূর্ব সুন্দরী। কিন্তু কোনো পুরুষ তাঁকে মোহিত করতে পারেনি। অবশেষে হজরত সুলাইমান (আ.)-এর সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়।

আল্লাহ হজরত সুলাইমান (আ.)-কে বিরল ক্ষমতার অধিকারী করেছিলেন। পশুপাখি, জিন থেকে শুরু করে প্রবাহিত বাতাস পর্যন্ত তাঁর অনুগত ছিল। তাঁর বাহিনীতে অসংখ্য জিন ও পশুপাখি সংযুক্ত ছিল। একদিন হজরত সুলাইমান (আ.) তাঁর অনুগত ‘গোয়েন্দা পাখি’ হুদহুদকে অনুপস্থিত দেখলেন। এতে রাগান্বিত হলেন এবং বললেন, যথাযথ কারণ দর্শাতে না পারলে হুদহুদ কঠোর শাস্তির মুখোমুখি হবে। কিছুক্ষণ পর হুদহুদ ফিরে এলো এবং রানি বিলকিসের রাজ্য, রাজত্ব, ক্ষমতা, প্রাসাদ ও সিংহাসন সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিল। তিনি রানিকে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপনের আহ্বান জানিয়ে চিঠি পাঠান। উত্তরে রানি বিপুল পরিমাণ উপঢৌকন প্রেরণ করেন হজরত সুলাইমান (আ.)-এর দরবারে। এতে ছিল নগদ স্বর্ণ-রৌপ্য, দাস-দাসিসহ বহু মূল্যবান সামগ্রী। সঙ্গে পাঠান ৪০ সদস্যের উচ্চতর কূটনৈতিক দল। কিন্তু জাগতিক এই ধন-সম্পদের প্রতি কোনো মোহ ছিল না হজরত সুলাইমান (আ.)-এর। তিনি তা প্রত্যাখ্যান করলেন এবং জানালেন, মানুষকে কুফর ও শিরকমুক্ত করে একত্ববাদের পথে নিয়ে আসাই তাঁর মূল চাওয়া। আল্লাহ হজরত সুলাইমান (আ.)-কে যে ক্ষমতা, ঐশ্বর্য ও প্রাচুর্য দান করেছেন, রানি বিলকিসের প্রতিনিধিদের সে সম্পর্কেও ধারণা দিলেন তিনি।

রানি বিলকিস হামিরের নেতাদের যুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়ার নির্দেশ দিলেন। সেনা সমাবেশ ঘটানো হলো এবং যুদ্ধের সর্বাত্মক প্রস্তুতিও নেওয়া হলো। রানি জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন। তিনি বলেন, ‘যদি সুলাইমান (আ.) আমাদের উপহার গ্রহণ করেন, যুদ্ধ না করে আল্লাহর পথে আহ্বান জানান, তাহলে বুঝতে হবে তিনি সত্য নবী। আর যদি তিনি উপহার প্রত্যাখ্যান করেন,  তাহলে তিনি পৃথিবীর অন্যান্য রাজার মতোই একজন রাজা। আমরা তাঁর সঙ্গে যুদ্ধ করব। কোনো শক্তি আমাদের পরাজিত করতে পারবে না। আর তিনি যদি সত্যি নবী হন, কোনো শক্তি আমাদের রক্ষা করতে পারবে না।’

রানি বিলকিসের প্রতিনিধিদল হজরত সুলাইমান (আ.)-এর দরবার থেকে ফিরে তাঁকে জানাল, আল্লাহর শপথ! তিনি কোনো সাধারণ রাজা নন। আমরা তাঁর সঙ্গে যুদ্ধ করার শক্তি রাখি না। কোনো দিক বিবেচনায় আমরা তাঁর চেয়ে শ্রেষ্ঠ নই। প্রতিনিধিদলের উত্তর শুনে হজরত সুলাইমান (আ.)-এর সঙ্গে দেখা করার সিদ্ধান্ত নেন রানি বিলকিস। তিনি বার্তা পাঠান, ‘আমি আমার রাজ্যের নেতাদের নিয়ে আপনার কাছে আসছি। আমি আপনার রাজত্ব ও ধর্ম—দুটিই নিজ চোখে দেখতে চাই।’

হজরত সুলাইমান (আ.)-এর দরবারে যাওয়ার আগে তিনি সাধারণ মানুষের উদ্দেশে বলেন, ‘হে হামিরবাসী! তোমরা আল্লাহর মনোনীত জাতি! তিনি তোমাদের বহু দিক থেকে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন। আল্লাহ তাআলা তাঁর নবী সুলাইমান ইবনে দাউদ (আ.)-এর মাধ্যমে তোমাদের পরীক্ষা করছেন। যদি তোমরা ঈমান আনো এবং আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ হও তাহলে আল্লাহ তাঁর অনুগ্রহ বাড়িয়ে দেবেন। আর যদি তোমরা অস্বীকার করো তাহলে তিনি তাঁর নিয়ামত ছিনিয়ে নেবেন। তোমাদের ওপর দুর্ভোগ চাপিয়ে দেবেন।’ জনসাধারণের পক্ষ থেকে জানানো হলো, সিদ্ধান্ত আপনার হাতে। অতঃপর তিনি এক লাখ ১২ হাজার সেনার এক বিশাল বাহিনী নিয়ে রওনা হন। অবশিষ্ট সেনাদের গামদান ও মারাবে রেখে যান।

ইসলাম হিস্ট্রি ডট কম অবলম্বনে

Visits: 0

মন্তব্য
Loading...
//dolatiaschan.com/4/4139233