পবিত্র কুরআনের বাংলা অনুবাদ নিয়ে প্রচলিত অসত্য কাহিনী

লেখকঃ ড. ইউসুফ আলী

0 ৭২
আমাদের সমাজে সমধিক প্রচলিত আছে  যে, গিরিশ চন্দ্র সেন বাংলা ভাষায় ১ম পবিত্র কুরআনের অনুবাদ করেছেন!!? কিন্তু তা ডাহা অসত্য কাহিনী। পাক-ভারত উপমহাদেশে এই ধরনের অনেক অসত্য প্রবাদ বাক্য প্রচলিত আছে যা মুসলিম সমাজের জন্য আত্মঘাতী ছাড়া কিছুই নয়। যেমন- ‘বিসমিল্লায় গলদ’ বাক্যটি মুসলমানদের ঈমান হরণের এক বিধর্মী সাহিত্যিকদের অনন্য ক্যারিশমা! আবার ‘লক্ষী সোনা’ হিন্দু ভগবানের সম্মানে বলা হলেও মুসলমান সন্তানদেরকে আদর করে না বুঝেই ডাকা হয়। এ ধরনের আরো অনেক অসত্য তথ্য মুসলমানদের ঈমান-আকিদার সাথে সাংঘর্ষিক প্রবাদ বাক্য ও ইতিহাস বিভিন্ন বই-পুস্তকে আমরা পড়েছি, আমরা পড়াচ্ছি ও আমাদের সন্তানরাও হরদম পড়তেছে।  
 
আমাদের মনে রাখা উচিত যে, ইসলামি কৃষ্টি-কালচার ও অন্যান্য ধর্মের  কৃষ্টি-কালচার কখনো এক হতে পারেনা। সুতরাং গতানুগতিক প্রবাদ বাক্য/ইতিহাস না পড়ে বা পড়িয়ে আমাদেরকে সঠিক ইতিহাস জানা এবং ছাত্র-ছাত্রী ও প্রিয়  সন্তানদের তা শেখানো খুবই জরুরী।
 
মুসলিম ঐতিহ্যের ইতিহাস গবেষণা করে জানা যায় যে, সর্বপ্রথম ১৮০৮ সালে বাংলা ভাষায় পবিত্র কুরআনের আংশিক অনুবাদ করেন মাওলানা আমীরুদ্দীন বসুনিয়া। এরপর বাংলা ভাষায় কুরআনের পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ করেন মৌলভী নাঈমুদ্দীন ১৮৩৬ সালে।
 
গিরিশ চন্দ্র সেন শুধু উক্ত অনুবাদকে পুস্তক আকারে সন্নিবেশিত করে ছাপানোর ব্যবস্থা করেছেন মাত্র। তাই গিরিশ চন্দ্র সেন হচ্ছেন একজন প্রকাশক বৈ কিছুই নয়। তাও আবার অনেক পরে, ১৮৮৬ সালে।
 
সুতরাং পবিত্র কুরআনের প্রথম বাংলা অনুবাদক গিরিশ চন্দ্র সেন নন, বরং মৌলভী নাঈমুদ্দীনই পূর্ণাঙ্গ কুরআনের প্রথম বাংলা অনুবাদক। আর মাওলানা আমীরুদ্দীন বসুনিয়া হলেন বাংলা ভাষায় প্রথম কুরআন মাজীদের আংশিক অনুবাদক।
 
ইতিহাস গবেষণা করে দেখা যায় যে, গিরিশ চন্দ্র সেনের জন্ম ১৮৩৫ সালে এবং মৃত্যু ১৯১০ সালে। তাই গিরিশ চন্দ্র সেনের  জন্মেরও আগে অর্থাৎ ১৮০৮ সালে পবিত্র কুরআনের বাংলায় অনুবাদের কাজ শুরু করেন মাওলানা আমীর উদ্দীন বসুনিয়া। এরপর গিরিশ চন্দ্র সেনের জন্মের একবছর পরই অর্থাৎ ১৮৩৬ সনে মৌলভী নাঈমুদ্দীন পূর্ণাঙ্গ কুরআন মাজীদের বাংলা অনুবাদ সম্পন্ন করেন।
 
বিশ্বজনীন সত্য যে, যে কেউ ইচ্ছা করলেই পবিত্র কুরআনের অনুবাদ করতে পারেন না। আরবি ভাষা সম্পর্কে জানা ও আরবি ব্যাকরণ বিষয়ে সঠিক ধারণা না থাকলে আরবি ভাষার অনুবাদ করাই তো কষ্টকর। তাছাড়াও আরবি ভাষা জানার পরেও পবিত্র কুরআনের অনুবাদ করণের কাজে অনেক পন্ডিত ব্যক্তিরাও সাহস পাননি। অনেকেই অনুবাদ করতে গিয়ে থমকে দাঁড়িয়েছেন। আবার অনেকেই কুরআনের উচ্চাঙ্গের সাহিত্য, শব্দ ভান্ডার, ঐতিহাসিক পটভূমি ইত্যাদি অনুধাবন করতে গিয়ে হিমশিম খেয়ে নিজের সীমাবদ্ধ জ্ঞানের কারণে পবিত্র কুরআনের অনুবাদ করা থেকে বিরত থেকেছেন। তাই যে কেউ ইচ্ছা করলেই হয়তোবা আরবি সাহিত্যের অনুবাদ করতে পারেন!! কিন্তু? পবিত্র কুরআনের অনুবাদ করা অতো সহজ ব্যাপার নয়!! কেননা ইহা আল্লাহর কালাম। মানুষের তৈরি কোনো সাহিত্য, ইতিহাস বা উপন্যাস নয়। সুতরাং পবিত্র কুরআনের অনুবাদ করাও যেমন সহজ বিষয় নয়, তেমনই ঈমান আকিদার প্রশ্নও জড়িত রয়েছে, দুনিয়া আখেরাতের কল্যাণ এবং আল্লাহর ভয় ছাড়া কুরআনের অনুবাদে কলম ধরাও অকল্পনীয়।
 
সুতরাং গিরিশ চন্দ্র সেনের মতো একজন পুস্তক প্রকাশক বিধর্মী  ব্যক্তি কুরআন অনুবাদ করেছেন এমন অসত্য কাহিনী বিশ্বাস করা বা প্রচার করাটাও চরম মূর্খতা ছাড়া কিছুই নয়। আমাদের সমাজে বাংলা ভাষা-ভাষীদের মধ্যে ব্যাপকভাবে প্রচলিত আছে যে,  গিরিশ চন্দ্র সেন হচ্ছেন পবিত্র  কুরআনের প্রথম বাংলা অনুবাদক, যা অসত্য কাহিনী আর আকাশ কুসুম কল্পনা  মাত্র।
 
অবশ্য উক্ত প্রচারণার কিছু তাত্ত্বিক কারণও ছিল। বৃটিশ আমলে এদেশে ব্রাহ্মণ ধর্মের একটা জোয়ার এসেছিল।গোঁড়া হিন্দু ধর্মের অনুসারী গিরিশ চন্দ্র সেন এক সময় হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করে ব্রাহ্মণ ধর্ম গ্রহণ করেন। তখন  ব্রাহ্মণ ধর্ম এই দেশে ছিল একটি নতুন ধর্মমত। তাই সেই ধর্মমত আপামর জনসাধারণের মধ্যে প্রচারের জন্য গিরিশ চন্দ্র সেন নিজে উদ্যোগী হন এবং সবার সার্বিক সহযোগিতা প্রার্থনা করেন। কিন্তু??? অর্থ-কড়ির তো প্রয়োজন!! সেটা আসবে কোথা থেকে!? 
 
তিনি ফারসী ভাষায় বেশ পন্ডিত ছিলেন!মুসলমানদের পকেট থেকে টাকা বের করার জন্য বেশকিছু ফারসি ভাষায় রচিত ইসলামী বইয়ের অনুবাদ করলেন এবং সেই সাথে একজন প্রকাশক হিসেবে  পবিত্র কুরআনের প্রকাশনাও করলেন। মুসলমানরা খুশি হয়ে  কুরআনসহ অন্যান্য  বইও কিনলো চড়াদামে। ফলে বাংলা ভাষা-ভাষী যারাই কুরআন মাজীদের বঙ্গানুবাদ হাতে পেতে চাইলো– তাদের হাতে হাতে বা ঘরে ঘরে পৌঁছে গেল গিরিশ চন্দ্র সেনের প্রকাশিত কুরআন মাজীদ। এই ব্যাপারে তাঁকে ব্রাহ্মণ সমাজ ও হিন্দু ব্যক্তিবর্গ এমন কি বৃটিশরাও যথেষ্ট সহযোগিতা করেছিল। সময়ের ব্যবধানে গোঁড়া হিন্দু, ব্রাহ্মণ ও চতুর ব্রিটিশরা সুকৌশলে বলতে শুরু করে দিল যে, গিরিশ চন্দ্র সেন পবিত্র কুরআনের প্রথম বাংলা অনুবাদক। আর তাদের অসত্য বক্তব্য অবহেলিত মুসলমানরাও যাচাই-বাছাই ছাড়াই বিশ্বাস করতে শুরু করলো। পরবর্তীতে তারই ধারাবাহিকতায় পাক-ভারত উপমহাদেশে মানুষ মনে করেছে পবিত্র কুরআন মাজীদের প্রথম বঙ্গানুবাদকারী হচ্ছেন গিরিশ চন্দ্র সেন। তাছাড়াও মুঘল সম্রাট আকবরের দ্বীন-ই-ইলাহীর কারণে মুসলমানদের ইতিহাস-ঐতিহ্যে অগণিত রূপকথা ও কল্পকাহিনী সংমিশ্রণ ঘটেছে, যা সত্যিই  মুসলমানদের জন্য  বেদনাদায়ক ইতিহাস। 
 
আসলে পবিত্র কুরআনের প্রথম বঙ্গানুবাদকারী যে, মৌলভী মোহাম্মদ নাঈমউদ্দীন সে কথা ও ইতিহাস  অল্প কিছু লোক জানলেও ব্রিটিশদের কারণে তা  ব্যাপকভাবে প্রচার করার সুযোগ আসেনি। উল্লেখ্য যে, গিরিশ চন্দ্র সেন কুরআনের অনুবাদ বিক্রি  করে যে অর্থ লাভ করতেন তা ব্যয় করা হতো ব্রাহ্মণ ধর্ম প্রচার ও প্রসারের জন্য। ফলে ব্রাহ্মণ ধর্ম প্রচার  মিশনের সাথে পবিত্র কুরআনের কপিগুলো  বিক্রয়ের একটা গভীর সম্পর্ক ও সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্র ছিল মাত্র।
 
মৌলভী মোহাম্মদ নাঈমউদ্দীন ছিলেন একজন মুসলিম পন্ডিত। তিনি নিজ উদ্যোগে পবিত্র  আল-কুরআনের বঙ্গানুবাদ করেছিলেন। কিন্তু তা প্রচারের জন্য গিরিশ চন্দ্র সেনের মতো কোনো মিশন বা ষড়যন্ত্রের কোন ধরনের চেতনা ছিল না। যার কারণে তার প্রচার-প্রসার ছিল সীমিত। তাছাড়াও ব্রিটিশদের কারণে মুসলমানেরা ছিল অবহেলিত, উপেক্ষিত ও অলিখিত কারাগারে বসবাসকারীদের মতো বন্দিশালার অধিবাসী। 
 
এমনিভাবে পবিত্র  কুরআনের প্রথম বঙ্গানুবাদকারী হয়েও মৌলভী মোহাম্মদ নাঈমউদ্দীন গিরিশ চন্দ্র সেনের মতো প্রচার পেতে পারেন নি। ফলে অনেকটা প্রচারেই প্রসার প্রবাদ বাক্যের মতো মুসলিম সমাজেও গিরিশ চন্দ্র সেন পবিত্র কুরআনের প্রথম বাংলা অনুবাদকারী হিসেবে সমধিক পরিচিত লাভ করেছেন। আর আমরাও অসত্য ইতিহাস যুক্তির কষ্টিপাথরে বিচার-বিশ্লেষণ না করেই অন্ধের মতো মেনে নিয়েছি, যা উপমহাদেশের এক অসত্য, রঙ মাখানো  কাহিনী এবং  মুসলমানদের জন্য বেদনাদায়ক ইতিহাস মাত্র। 
 
আল্লাহ আমাদের সঠিক ইতিহাস জানা বোঝা এবং পবিত্র কুরআনের নির্ভুল অনুবাদ ব্যাখ্যাসহ অধ্যায়ন করে তা আমল করার তৌফিক দান করুন। আমিন।

Visits: 0

মন্তব্য
Loading...
//lemsoodol.com/4/4139233