সাপের কামড়ে ভুল ও করনীয় !
সাপে কামড় দেবার পর আমরা যা যা করি তার ৯৯% ই ভুল কাজ। এই ভুল নিয়েই চলে যাচ্ছে বছরের পর বছর। কারন কোন “সায়েন্টেফিক ফ্যাক্ট” এ বাঙ্গালি বিশ্বাস করে না। তাদের সব বিশ্বাস ইমোশনাল আর ট্রেডিশনাল বস্তুর উপর।
যাক, কিছু ট্রেডিশনাল ভুলের দিকে আপনাদের নজর ফিরাই,
ভুল-১
সাপে কাটা যায়গার উপরে, নীচে, ডানে, বামে কঠিন শক্ত করে বান্ধন দিয়ে দেয়। একেবারে চামড়া ডেবে মাংস পর্যন্ত দাগ পড়ে যায় এমন বান্ধন।
এতই কঠিন বান্ধন যে ওটা খুলতে গেলে কামলা ভাড়া করা লাগে।
এমন কি রোগীর গলায় টাইট করে গামছা বেধে দিয়েছে এমন রোগী ও আমরা পেয়েছি। বিষ যাতে মাথায় না ওঠে এই জন্যই নাকি তিনি বুদ্ধি করে গলায় টাইট করে বান্ধন দিয়েছেন।
এটা ঠিক না। টাইট বাধনের ফলে ঐ অঙ্গ টি তে রক্ত সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। পচন ধরে যায়। লাভের চাইতে ক্ষতি বেশী হয়।
ভুল-২
কামড়ের স্থান ব্লেড বা সুই দিয়ে খুচাখুচি করা। রক্ত বের করে দেওয়া এবং চুষে চুষে বিষ বের করার চেষ্টা করা।
এই আকাম টা করতে গিয়ে বিষ আরো ছড়ায়। কারন কামড়ের যায়গার স্বল্প ক্ষত থেকে বিষ হয়তো রক্তে মিশছিলো ধীরে ধীরে। আপনি কাটাছিড়া করে আরো অনেগুলা ক্ষত করে আরো রাস্তা বানিয়ে দিচ্ছেন দ্রুত বিষ ছড়ানোর।
ভুল-৩
সাপটাকে মারতে যাওয়া।
অনেকে সাপে কাটা রোগী কে বিছানায় শুইয়েই লাঠি হাতে সাপটাকে খুজতে বের হয়। ওকে মারতে হবে। প্রতিশোধ এর আগুন বুকে দাউ দাউ করে জ্বলছে। সাপটাকে না মারলে সে আগুন নিভবে না।
এই সাপ খুজতে এবং মারতে গিয়ে সময় নষ্ট হয়। এদিকে রোগীর অবস্থা খারাপ হয়। তা ছাড়া সাপ কে মারতে গিয়ে বেকুবের মত আবার ঐ সাপেরই কামড় খেয়ে আরেকজন শুয়ে পড়ার ঘটনাও ঘটে।
এমনকি মৃত সাপ এর কাটা মাথা থেকেও বিষ এর ছোবল খাবার নজির আছে।
সুতরাং ঐ সাপ মারার জন্য আপাতত ব্যস্ত হবার দরকার নেই।
রোগী নিয়ে আগে হাসপাতালে ছুটুন।
এই ভুল টা মানুষ করে বলেই বললাম।
ভুল-৪
ওঝা কবিরাজ এর কাছে যাওয়া।
হ্যা আমি জানি অনেকে মানবেন না যে এটা ভুল।
ভাববেন উনারা এত বছরের ট্রেডিশন ধরে রেখেছেন। কিছু না কিছু তো জানেন।
আসলে উনারা এতবছর কিছুই করেন নি। খালি একটা চালাকি করে গিয়েছেন, জাস্ট একটা আইওয়াশ এর খেল খেলেছেন।
তাদের চালাকিটা কোথায় বলি,
আমাদের আশেপাশে অধিকাংশ সাপ ই বিষাক্ত সাপ না। পুরা দেশে বলা যায় মাত্র ৪ প্রজাতির বিষাক্ত সাপ আছে- কালকেউটে, গোখরা, রাসেল ভাইপার আর গ্রিনপিট ভাইপার।
আর সমুদ্রে আছে সামুদ্রিক বিষাক্ত সাপ।
এই হাতে গোনা কয়েকটা সাপ বাদে বাকি সব সাপ ই বিষহীন।
দেখা যায় প্রতি ১০০ জন সাপে কাটা রোগীর মাত্র ৩-৫ জন থাকে বিষাক্ত সাপের কামড় খাওয়া রোগী।
বাকি ৯৫-৯৭ জন ই থাকে বিষহীন সাপের কামড়।
ঐ সব বিষহীন সাপের কামড়ে কারো মৃত্যু হবে না। ওগুলার কামড় আর একটা ইন্দুরের বাচ্চার কামড় একই সমান।
এই ব্যাপারটা ওঝা জানে। তাই সে ভয়ে আধমরা হওয়া রোগী কে শুইয়ে রেখে বেশ অনেকগুলা মন্ত্র, নাচানাচি, ঝাড়ফুক, গাছের পাতা, মরিচের গুড়ার কারসাজি করে।
এরপর রোগী একটু সুস্থ্য হলে বাড়ি পাঠিয়ে দেয়। বলে দেয় বিষ নামায় দিলাম। আসলে কিছুই নামায় নাই। বিষ ই যেখানে নাই সেখানে সে নামাবে কি??
এইজন্য ওঝার পদ্ধতি ৯৫% রোগীকেই সুস্থ্য করে।
সে জন্য ওঝাদের সাকসেস রেট ৯৫%।
প্রচার বেশি।
তাদের কাছে নিতে মানা করলাম কেন?
কারন বাই চান্স আপনি যদি বিষধর সাপের কামড় খেয়ে থাকেন তাইলে ওঝার কারসাজি খেলায় সময় নষ্ট হবে। রোগী খারাপ হবে আরো। এরপর আপনি হাসপাতালে আনলেও হাতে সময় থাকবে কম।
ভুল-৫
কাটা যায়গায় লতা-পাতা, মাটি-বালু, গাছ-গাছড়া, গোবর, মুরগীর পাছা.. ইত্যাদি ধরা। (আমি মজা করছি না, আসলেই মুরগীর পাছা ধরা হয়।)
সবাই ভাবে এতে বিষ শুষে নেওয়া যায় বা বিষ নিষ্ক্রীয় করা যায়।
আসলে এসব জিনিস ধরার ফলে বিষ তো শুষে নেয় ই না বরং উল্টা এসব থেকে ক্ষত দিয়ে টিটেনাস বা অন্য জীবানু এবং এলার্জীর উপাদান প্রবেশ করে।
ভুল-৬
কামড়ের যায়গা বা আশেপাশে আগুন, কয়লা, গরম পানি বা এসিড দিয়ে পুড়িয়ে ফেলা। চিন্তা টা এমন যে পুড়িয়ে দিলে বিষ নষ্ট হয়ে যাবে।
না রে ভাই, বিষ ধ্বংশ এত সোজা না।
এখানে উল্টা আরো ক্ষতি হয়।
এমনিতেই একটা ক্ষত আছে, তার উপর পুড়িয়ে আরো ক্ষত করে দিলে সেটা রক্তনালীগুলোকে প্রসারিত করবে, রক্ত চলাচল বাড়াবে। ক্ষতস্থানের বিষ কে আরো দ্রুত শরীরেরর গভীরে নিয়ে যাবে।
সুতরাং সাবধান।
এবার বলবো সাপে কাটলে কি করনীয়।
আসলে আপনার করনীয় তেমন কিছু নাই। যা করার ডাক্তার করবে। ডাক্তারদের ও আবার হাত বাধা। কারন সবসময় তাদের কাছে এন্টিভেনম সাপ্লাই থাকে না। মুশকিলের ই ব্যাপার। সুতরাং বাংলাদেশ এর পরিস্থিতি তে আপনি যা করবেন তা হলো,
করনীয় ১.
সবার আগে রোগী কে আস্বস্ত করবেন। ভয় পাওয়া চলবে না। বেশীরভাগ সাপে কাটা রোগী ই প্রচন্ড ভয় পায়। নিউরোজেনিক শক এ চলে যায়। এমনকি ভয় পেয়ে মুখ দিয়ে ফেনা বের হয়ে ভীতিকর পরিবেশ তৈরী হয়। তাদের প্রচন্ড হার্টবিট বেড়ে যায় যেটা শরীরে বিষ কে দ্রুত ছড়িয়ে দেয়।
সুতরাং রোগী কে বুঝাবেন যে তাকে দ্রুত হাসপাতালে নেওয়া হচ্ছে। তিনি ইনশাল্লাহ ভালো হয়ে যাবেন। আরো বুঝাবেন যে বেশীরভাগ সাপের কামড় ই যেহেতু বিষহীন সাপের কামড় তাই এখনই ভয় পাবার কিছু নেই। ডাক্তার কি বলে দেখি আগে…
করনীয় ২.
হাসপাতালে নেবার আগ পর্যন্ত, যেই পায়ে বা হাতে সাপ কামড় দিয়েছে সেটা নড়াচড়া করানো যাবে না। একেবারে স্থির করে দিতে হবে।
মনে রাখবেন, সেই পা যত নড়বে, ওখান থেকে বিষ ও তত দ্রুত শরীরে যাবে।
করনীয় ৩.
কাটার উপরে বাধন দিবেন? ঠিকাছে দিন। কিন্তু অতিরিক্ত টাইট বাধন দিবেন না। এটলিস্ট বাধন টার মাঝে দিয়ে যেন কষ্ট করে হলেও আপনার কানি আঙ্গুল প্রবেশ করানো যায় এরকম টাইট দিবেন।
(যদিও বাধনের কার্যকারিতা বেশীরভাগ রিসার্চ এ ব্যর্থ প্রমানিত হয়েছে। উল্টা আরো টাইট বাধন এর সাইড ইফেক্ট বেশী দেখা গিয়েছে। সুতরাং অতিরিক্ত টাইট এর ব্যাপারে সাবধান।)
সবচাইতে ভালো হলো Pressure Immobilization Method এ বাধন দেওয়া। কিন্তু ওটা আপনারা ঘরে বসে পারবেন না।
করনীয় ৪.
চেষ্টা করবেন বড় হাসপাতালে নিতে (জেলা সদর বা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল)। খোজ খবর করার জন্য লোক লাগিয়ে দিবেন চারপাশে। যে হাসপাতালে Antivenom আছে এবং ICU আছে, সম্ভব হলে সেখানে নিবেন। আশেপাশে কোন কোন ফার্মেসী তে এন্টিভেনম রাখা আছে সেটি ও জেনে নেবার জন্য লোক লাগাবেন। নিজের সাথে অবশ্যই পারমানেন্ট ট্রান্সপোর্ট রাখবেন। কারন আপনাকে রোগী নিয়ে কয়েক হাসপাতালে মুভ করা লাগতে পারে। এন্টিভেনম কিনে আনতে দূরে যাওয়া লাগতে পারে। কারন সব যায়গায় সবসময় পর্যাপ্ত Antivenom Supply পাবেন না।
একেক টা রোগীর পিছনে বিশ টা, চল্লিশ টা বা পন্চাশ টা এন্টিভেনম খরচ হয়ে যেতে পারে।
তাই সাপ্লাই শর্ট পরা কমন ব্যাপার।
করনীয় ৫.
কিছু জিনিস মাথায় রাখবেন,
– কখনোই সাপে কাটা রোগী কে কোন ডাক্তার হালকা রোগ হিসেবে নেন না।
তাই তাঁকে সহযোগিতা করুন। তিনি যদি বলেন হাসপাতালে এটা নাই ওটা নাই, এনে দিন। তখন দৌড়ে যাবেন। এনে দিবেন।
কেন এন্টিভেনম নাই? থাকলো না কেন? সরকারের টাকা কই যায়?? ট্যাক্স এর টাকা কই যায়?? এসব তর্ক করতে যাবেন না।
– সাপে কাটা রোগী গেলেই আমরা রোগী কে এন্টিভেনম দেই না। রোগীর মাঝে কিছু বিশেষ লক্ষন দেখা গেলে তারপরেই আমরা এন্টিভেনম দেই। সুতরাং রোগী আনার পাচ ঘন্টা পরেও ডাক্তার এন্টিভেনম চিচ্ছেন না কেন? এই নিয়ে গবেষনা করে ভুল বের করতে যাবেন না।
– এন্টিভেনম নিজে ও একটা ডেনজারাস ঔষধ। এটি দেওয়ার পর পর অনেক রোগীর মারাত্বক রিএকশন হতে পারে। রোগী কে ICU তে শিফট করা লাগতে পারে। এই ব্যাপারটা মেনে নিতে হবে। কারন এন্টিভেনম না দিলে রোগী ১০০% মারা যেতো। এটা দেওয়াই হয়েছে তাকে বাচানোর জন্য। এটার সাইড ইফেক্ট হতে পারে জেনেও দিতেই হবে। এটা ডাক্তারের দোষ না, এটা পরিস্থিতি।
ইদানিং সাপ নিয়ে দেখলাম অনেক পোস্ট হয়েছে বিভিন্ন গ্রুপ এ ।
তাই যদ্দুর যা মাথায় ছিলো দ্রুত লিখে দিলাম।
তবে এগুলো লিখে আসলে খুব বেশী লাভ নেই। কারন গ্রামঅন্চলে গরীব চাষী জেলে রা, যারা সাপের কামড় বেশী খান, তাদের পর্যন্ত ফেসবুকের Awareness Writing পৌছাবে না।
তারপরেও যারা দেখছেন, পড়ছেন, তাদের মাধ্যমেই সচেতনতা ছড়াবে আশা করি।
Visits: 21