Self বা আমিত্ব শব্দটি আধ্যাত্মিক অর্থবহন করলেও আধুনিকতায় এর ব্যাপক অর্থদ্যোতকতা রয়েছে। আমিত্ব শব্দটি মূলত ব্যক্তির ব্যক্তিত্বকে বোঝায় বা প্রতিনিধিত্ব করে। এখানে ব্যক্তি ও ব্যক্তিত্ব একে অপরের পরিপূরক কেননা ব্যক্তিত্ব যদি ফল হয় , ব্যক্তি তাহলে ফলগাছ। একজন মানুষের ব্যক্তিত্বের সাধারণত দুটি পরস্পরমূখী দিক আছে। প্রথম দিকটি হলো ব্যক্তি নিজেকে কিভাবে দেখে এবং পরের দিকটি হলো প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর ভিতর দিয়ে ব্যক্তিকে কিভাবে দেখা হচ্ছে। যেমন একজন সিরিয়াল কিলারও নিজেকে নির্দোষ দাবী করে যুক্তিপেশ করে। কিন্তু আইনের দৃষ্টিতে সে দূধর্ষ অপরাধী।
প্রশ্ন হলো আধুনিক রাষ্ট্রে ব্যক্তিত্ব এত গুরুত্বপূর্ণ কেন? গুরুত্বপূর্ণ এই কারণে যে আধুনিক রাষ্ট্রের মৌলিক একক হলো ব্যক্তি। অর্থাৎ নাগরিক। আর যেহেতু ব্যক্তিত্ব ব্যক্তিকে নির্ধারণ করে দেয় তাই ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠার প্রক্রিয়াটা রাষ্ট্রের জন্য অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ব্যক্তিত্বের প্রভাবক হিসেবে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান কাজ করে। যেমন- পরিবার, ধর্ম, সমাজ, রাজনীতি এবং অর্থনীতি। প্রতিটিরই খুব সূক্ষ্ম কিছু প্রভাব আছে।
মানুষের জন্য তাই আত্মপরিচয় অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ এবং অর্থবোধক। কেননা আত্মপরিচয়ই নির্ধারণ করে রাষ্ট্রের সাথে ব্যক্তির সম্পর্ক কেমন হবে। সাধারণ দৃষ্টিতে দেখতে গেলে ব্যক্তির আত্মপরিচয় শুরু হয় তার জন্মের পরে নামকরণের মধ্য দিয়ে। তার ভাষা, চিন্তা, জীবনযাপন সবকিছুর মধ্য দিয়ে আত্মপরিচয় ধীরে ধীরে পূর্ণাঙ্গতা লাভ করে।
ব্যক্তিগত জীবনের ব্যক্তিত্ব আর নাগরিক ব্যক্তিত্বের মধ্যে ব্যাপক প্রায়োগিক পার্থক্য রয়েছে। নাগরিক ব্যক্তিত্ব শুরু হয় রাষ্ট্রীয় ভাষার স্বীকৃতির মধ্য দিয়ে। রাষ্ট্রীয় ভাষা কেবল মনের ভাব প্রকাশ বা যোগাযোগের মাধ্যম তাই নয় বরং ভাষা হলো রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রক প্রকল্প। একটি শিশুকে যখন ভাষা শেখানো হয় তখন তাকে উপদেশ, আদেশ-নিষেধের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় মূল্যবোধও শেখানো হয়। কিভাবে খেতে হয়, কিভাবে বড়দের সাথে কথা বলতে হয়, কাকে কি বলে সম্বোধন করতে হয়, পোষাক কিভাবে পরতে হয় অথবা হয় না।
এসব জীবনাচরণের মাধ্যমে শিশুটি একটি বিশেষ মূল্যবোধ বা নৈতিকতাসম্পন্ন এবং ব্যক্তিত্ব নিয়ে বড় হয় এবং এভাবেই রাষ্ট্রীয় আইন-কানুন তথা মূল্যবোধ শেখে। এখানে লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো পরিবারের মাধ্যমে পাওয়া এই রাষ্ট্রীয় মূল্যবোধের উপাদানের পরিমাণ একেক শিশুর মধ্যে একেক রকম। এটার কারণ হলো রাষ্ট্র হলো বৃহদাকার “পাওয়ার এনটিটি”।
তাই ক্ষুদ্রতম ব্যক্তি আর বৃহত্তম ক্ষমতাধর রাষ্টের মধ্যে অনেক অনেক উপাদান অনুঘটক হিসেবে কাজ করে যেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো ধর্ম ও অর্থনীতি। একটি শিশুর আত্ম পরিচয় যেমন ধর্মের ভূমিকা অনুস্বীকার্য তেমনি রাষ্ট্রীয় মূল্যবোধ তৈরীতেও অর্থের ভূমিকা অনস্বীকার্য। পরবর্তী জীবনে বড় রকমের কোন অলৌকিক ঘটনা না ঘটলে মৃত্যু পর্যন্ত শিশুটি সেই মূল্যবোধকে কেন্দ্র করেই বিকশিত হয়।
একজন নাগরিক নিজে যেমন রাষ্ট্রের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় তেমনিক রাষ্ট্রও নাগরিক দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। আর এজন্যই নাগরিক ব্যক্তিও রাষ্ট্রের জন্য এত গুরুত্বপূর্ণ।
এখন প্রশ্ন হলো রক্তমাংসের মানুষ রাষ্ট্রের মত বিমূর্ত সত্ত্বার কাছে কিভাবে পৌছায়? এটার উত্তর খোঁজার আগে কিছু ব্যাপার পরিষ্কার করা যেতে পারে। আমরা যখন মানুষ কল্পনা করি তখন কোনো রক্তমাংসের মানুষ আমাদের কল্পনায় আসেনা। কোনো বিশেষ লিঙ্গের মানুষও কল্পনায় আসেনা (তবে যিনি কল্পনা করছেন তার নিজের লিঙ্গ পরিচয় কল্পনাকে প্রভাবিত করতেও পারে) আমরা যখন মানুষ কল্পনা করি তখন মানুষের জীবন, জীবিকা, কর্ম বিভিন্ন বিষয় কল্পনা করি।
অর্থাৎ মানুষ এখানে “বিমূর্ত” অস্তিত্ব নিয়ে হাজির হয়। উদাহরণস্বরুপ গান্ধীকে চিন্তা করতে গেলে ব্যক্তি গান্ধী নয় বরং তার অহিংসবাদ নিয়েই চিন্তা করি। অর্থাৎ রক্তমাংসের মানুষ তার নিজস্ব মূল্যবোধ বা নৈতিকতার ভিত্তিতে বিভিন্ন কর্মের মাধ্যমে বিমূর্ত হয়ে ওঠে। এখানেই নাগরিকের ক্ষমতা। এই ক্ষমতার ভিত্তি যেই মূল্যবোধ বা নৈতিকতা প্রকাশটাও ঠিক তাকেই কেন্দ্র করেই ঘটে।
উল্লেখ্য যে মূল্যবোধ ও কর্ম সরাসরি ঘটেনা। এদু’টোর মাঝখানে থাকে চিন্তা, ব্যক্তি চিন্তা করে। তার মূল্যবোধের সাথে সাংঘর্ষিক বা প্রাসঙ্গিক সবদিক নিয়েই ব্যক্তি চিন্তা করে। তার চিন্তার জগতটা হলো মূল জায়গা যেখানে রাষ্ট্রের ইতিবাচক অথবা নেতিবাচক মিথস্ক্রিয়া ঘটে। ব্যক্তির চিন্তাজগত অপরিবর্তনীয় নয়। বরং তা প্রতি মুহূর্তে পরিবর্তিত হচ্ছে। অনিবার্যভাবেই তাই রাষ্ট্রের সাথেও ব্যক্তি বা নাগরিকের সম্পর্কেরও পরিবর্তন ঘটছে।
আধুনিক রাষ্ট্র যেহেতু পাওয়ার এনটিটি তাই তাকে ক্ষমতা প্রয়োগ করতে গেলে হয় বিমূর্ত নয় মূর্ত রুপ নিয়েই হাজির হতে হয়। প্রকৃতপক্ষে রাষ্ট্র হলো একটা কাঠামোর নাম। কাঠামোটা বিমূর্ত কিন্তু কাঠামোর পরিচালকগণ অর্থাৎ শাসকশ্রেণি বিমূর্ত নয়। তাই ক্ষমতা প্রয়োগের জন্য রাষ্ট্র কখনো মূর্ত কখনো বিমূর্ত রুপ ধারণ করে।
বিমূর্ততার অসাধারণ ক্ষমতা আছে। সহজেই কোনো বিমূর্ত ধারণা মানুষের ভিতরে উদ্দিপনা উন্মত্ততা তৈরি করে দিতে পারে যা বৈপ্লবিক রুপ ধারণ করারও ক্ষমতা রাখে। তাই রাষ্ট্র প্রয়োজনবোধে দুটো রুপ ধারণ করলেও সে নাগরিকের বিমূর্ততা তথা মূল্যবোধ বা চিন্তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়।
কিন্তু সমস্যা হলো ব্যক্তির বিমূর্ততা তথা চিন্তাকে কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে? এটি কি আদৌ সম্ভব? সম্ভব হলে কিভাবে সম্ভব। তার চেয়েও বড় প্রশ্ন আধুনিক রাষ্ট্র কেন নিয়ন্ত্রণ করতে চায়?
প্রথমে রাষ্ট্র দিয়েই শুরু করা যাক। রাষ্ট্র কেন ব্যক্তি-বিমূর্ততাকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়? এখানে বিমূর্ততা হলো মূলত নাগরিকের চিন্তার জগতটা। রাষ্ট্রেরও অনন্য মৌলিক বৈশিষ্ট্য আছে। তা হলো সার্বভৌমত্ব। সার্বভৌমত্বের কারণেই রাষ্ট্রকে নিয়ন্ত্রণকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হয়। নাগরিকের মত রাষ্ট্র নিজেকে স্বাধীন, ক্ষমতাধর ও সার্বভৌম হিসেবে জাহির করে।
সার্বভৌম আধুনিক রাষ্ট্র নাগরিককে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সর্বদা নাগরিককে শারীরিক জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। এই নিয়ন্ত্রণ করার জন্য আধুনিক রাষ্ট্রে ব্যাপক সব আয়োজন করা হয়ে থাকে। যেমন – আইন বিভাগ, বিচার বিভাগ, আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী ইত্যাদি। এগুলোর মাধ্যমে যেমন অপরাধকে শাস্তি দেয়া হয়, সমাজে ন্যায়, সাম্য প্রতিষ্ঠা করে নাগরিকদের স্বাভাবিক জীবন নিশ্চিত করা যায়। তেমনি রাষ্ট্রের যেকোনো ইচ্ছাও নাগরিকের উপর চাপিয়ে দেয়া যায়। প্রয়োজনবোধে দমননীতিও চালানো যায়। একই ভাবে রাষ্ট্র ‘নাগরিকের’ ভাবনা সম্পর্কে জানতে চায়, নাগরিক কি ভাবছে। কেন ভাবছে সব জানতে চায়। কারণ রাষ্ট্র নাগরিক চিন্তাকেও নিয়ন্ত্রণ করতে চায়।
এখন প্রশ্ন ওঠে আধুনিক রাষ্ট্র নাগরিকের চিন্তার জগত কিভাবে দৃষ্টিসীমার মধ্যে আনতে পারে? প্রকৃতপক্ষে চিন্তাকে নয় চিন্তার বহিঃপ্রকাশ করার মাধ্যমগুলোকে রাষ্ট্র নজরদারীর মধ্যে আনতে পারে। চিন্তা ততক্ষণ পর্যন্ত কোনো ইতিবাচক বা নেতিবাচক ফল আনতে পারেনা যতক্ষণ পর্যন্ত না তা প্রকাশ করা হয়। অর্থাৎ চিন্তার প্রকাশের মাধ্যমগুলোকে রাষ্ট্র নিজের চিন্তা দ্বারা প্রতিস্থাপিত, প্রভাবিত ও প্ররোচিত করতে চায়। যখন তা পারেনা তখনই আধুনিক রাষ্ট্র নাগরিকের বিমূর্ত চিন্তার প্রকাশকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়।
তাহলে এবার প্রশ্ন ওঠে নাগরিকের চিন্তার প্রকাশ কোথায় কোথায় এবং কিভাবে হয়? ব্যক্তির চিন্তার প্রকাশ কোথায় কিভাবে হয় তা বুঝা যায় কান্ট ও হেবারমাসের মাধ্যমে। এখানে কান্টকে উদ্ধৃত করা যেতে পারে। তিনি বলেছেন “আমি তাই, যা আমি চিন্তা করি। অর্থাৎ ব্যক্তি যাই করে তাই হলো তার চিন্তার বহিঃপ্রকাস। যেমন ব্যক্তি যা খায় আর যা খায় না। তাও কোন না কোন ভাবে তার মূল্যবোধ তাড়িত। স্বতঃপ্রণোদিত নয়। অর্থাৎ সে চিন্তা করছে কোনটা আমি খাবো অথবা খাবো না। তেমনিভাবে ব্যক্তি যে পোশাক পরিধান করছে সেটাও তার চিন্তাকে প্রতিনিধিত্ব করে। এভাবে ব্যক্তির প্রতিটি কাজেই ব্যক্তির চিন্তার বহিঃপ্রকাশ।
আবার হেবারমাস ‘পাবলিক স্ফেয়ার” এর কথা বলেছেন। মূলত পাবলিক স্ফেয়ার ব্যক্তিচিন্তার সামষ্টিক বহিঃপ্রকাশ। বর্তমানে যেকোন গণমাধ্যমকে পাবলিক স্ফেয়ার হিসেবে ধরা যেতে পারে। বই, লেখনী, প্রিন্টমিডিয়া, ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া যেমন পাবলিক স্ফেয়ারের অন্তর্ভুক্ত তেমনি বর্তমানের বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমও পাবলিক স্ফেয়ারে রুপান্তরিত হয়ে গেছে।
তাই আধুনিক সেক্যুলার রাষ্ট্রে ব্যক্তি রাষ্ট্র মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড়িয়ে গেছে। এর ফলে একদিকে যেমন ব্যক্তি অন্যদিকে সেক্যুলার রাষ্ট্র বিভিন্ন ঝুঁকির মধ্যে পড়ে গেছে। কেননা আধুনিক রাষ্ট্র সেক্যুলার হলেও এর নাগরিক সেক্যুলার নয়। নাগরিক যখন পাবলিক স্ফেয়ারে এসে তার ধর্মীয় চিন্তা প্রকাশ করে তখন সেক্যুলার রাষ্টের অস্তিত্ত্ব হুমকির মুখে পড়ে যায়। ফলে সেক্যুলার রাষ্ট্রের সাথে ধার্মিক নাগরিকের সংহতি নষ্ট হতে থাকে এবং তা সমাজের বিভিন্ন স্তরে ধীরে ধীরে নষ্ট হয়। সেক্যুলার আধুনিক রাষ্ট্র তাই ধর্মীয় চিন্তার প্রকাশের পথকে নিয়ন্ত্রণ করে কখনো রুদ্ধ করে দেয়। তাও কারণ খুব সম্ভবত একমাত্র যেকোনো ধর্মীয় পোশাকেরই এই ক্ষমতা রয়েছে যা একটি মাত্র শব্দ উচ্চারণ না করেও না লিখেও গোটা ধর্মকে প্রকাশ্যে বহন, প্রচার ও প্রকাশ করতে পারে।
আদর্শের সাথে আদর্শের, চিন্তার সাথে চিন্তার, ক্ষমতার সাথে জ্ঞানের দ্বন্দ্ব প্রকাশ করে ধর্মীয় পোষাক। তাই আপাতদৃষ্টিতে ধর্মীয় পোশাক কেবল ধর্মীয় পোশাকই নয় বরং তা আধুনিক সেক্যুলার রাষ্ট্রের প্রতি নাগরিকের ছুড়ে দেয়া একটি চ্যালেঞ্জের প্রতীক।
সংগৃহীত-
আফিফা আমাতুল্লাহ
উচ্চতর গবেষক
সাবেক শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
Visits: 1