মানুষ মানুষের জন্য #১
তফাজ মিয়া আমাকে চা খাওয়াতে চান…
এটাই তাঁর জীবনের নাকি এখন সবচেয়ে বড় স্বপ্ন!এ জন্য আমার কাছে একটু সময় চান…
নয়ত বিএসএমএমইউ হাসপাতালের আনসার গুলোকে অনুরোধ করতে চান…উনি আমাকে চা খাওয়াতে আসলে কেউ যেন বাধা না দেয়!
তফাজ মিয়ার সাথে আমার পরিচয় এই ক’দিন আগে…ঈদের দিন…একজন সহকর্মীর মাকে হার্ট ফাউন্ডেশনে দেখতে গিয়েছিলাম…
এমনিতেই ঈদের দিন…তার উপর দুপুর বেলার প্রখর রোদ…রিকশা পাচ্ছিলাম না…অনেকক্ষণ পর পেলাম এক রিকশা! রিকশাওয়ালার এক শর্ত…আপনার বাড়ী পর্যন্ত যেতে পারব না…অর্ধেক রাস্তায় নামতে হবে…আমি তাতেই রাজি…কিছু পথ তো এগোনো যাবে।
চালক বৃদ্ধ প্রায়…কথার ফাঁকে জানলাম…নাম তফাজ মিয়া (ছদ্মনাম)…বয়স প্রায় ৭০…মেয়ে আছে, বিবাহিত। ছেলে নাই তাঁর। বাড়ী রাজশাহী! নিজে রোজগার করে যতটুকু পারে জীবন চালায়।
রিকশার গতি হাঁটার গতির সমান…মাঝপথে জিজ্ঞেস করলাম, বাবাজি বাড়ী পর্যন্ত যাবেন না কেন?
-একটু বেশি পরিশ্রম করলে বুকটা চেপে আসে বাবা…গলা, হাত টান দিয়ে ধরে…দম নিতে পারিনা…ঘাম হয়…মনে হয় এই বুঝি দম বাইর হই যাইব
মনটা খারাপ হয়ে গেল…বলে কি! এ যে হার্টের রক্তনালীতে ব্লকের লক্ষণ…এমন রোগীদের পূর্ণ বিশ্রামে থাকা উচিত…টেনশন করা উচিত না…একাধিক ঔষধ খাওয়া উচিত! আর উনি রিকশা চালাচ্ছেন!!
আমি তাই অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম…ডাক্তার আপনাকে রিকশা চালাতে বারণ করেনি?
পশ্ন শুনে তফাজ মিয়া বিচলিত হলেন না…তাঁকে অস্থিরও মনে হল না…বরং তিনি আরো শান্ত হয়ে গেলেন…রিকশার গতি কমিয়ে একদম থামিয়ে দিলেন…হাত দুটো আমার দিকে মেলে ধরে বললেন…এই দ্যাখেন বাবা, ৩০ বছর রিকশা চালাইয়া হাত দুইটারে কি বানাইছি…ডাক্তার তো রিকশা চালাইতে নিষেধ করছিল…আমার হাট নাকি ঠিকমতো নড়েই না…কিন্তু ক্যামনে বাদ দেই বাবা…পেট তো মানে না, জীবন তো থামে না…মাইন্সে দারোয়ান রাখবার চায়…যেই টাকা দেয়…সেইটা দিয়ে আমারই পেট চলে না…বউ টারে কি খাওয়ামু…
পকেট থেকে একটা নাইট্রোগ্লিসারিন স্প্রে বের করে বলল, এই যে বাবা দেখেন…বুকে ব্যথা উঠলে এই স্প্রে দেই…আর একটু বিশ্রাম নেই…বুকের চাপ ধরাটা কমে যায় তখন…এভাবেই চালাই বাবা।
রিকশা আবার চলতে লাগল…মাঝখানে একবার ঘাড় ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, বাবাজি, আপনি কি ছাত্র? আমি উত্তর দিলাম না…মুচকি হেসে জানতে চাইলাম, কেন?…বাবা, আমার টাকার দরকার নাই…একটা স্প্রে কিইন্যা দিবেন? কি যে দাম বাবা…মাস না যাইতেই ফুরত।
আমি অর্ধেক রাস্তাতেই নেমে গেলাম…তাড়াহুড়া করে বের হওয়ায় পকেটে টাকা ছিল না আমার…তফাজ মিয়ার হাতে একশ টাকা দিলাম…আমার কার্ড দিয়ে বললাম…আপনি যে রোগে ভুগছেন…আমি সে রোগের ডাক্তার…এই ঠিকানায় চলে আসেন…আপনাকে ফ্রি চিকিৎসা দিব…স্প্রেও কিনে দিব। কিন্তু…দুদিন পর যখন এই স্প্রে শেষ হয়ে যাবে…তখন কি করবেন?
কোন উত্তর খুঁজে পায় না তফাজ মিয়া…মাথা নিচু করে বলে, বাবাজি একটা ফ্ল্যাক্স হইলেই জীবনটা শান্তিতে কাটাতে পারতাম…আস্তে আস্তে হেঁটে হেঁটে চা বেচতাম…ঢাকা ভার্সিটিতে…ছেলে গুলো খুব ভাল…যা পাইতাম…তাতেই জীবনটা চলে যেত।
আমি বললাম, ফ্ল্যাক্সের দাম কত?
-৭০০ টাকা।
-খুব ভালোটা?
-৭০০ টাকা হলেই চলবে বাবাজি।
-কাপ লাগবে না? বালতি লাগবে না?
-জ্বী বাবাজি, হেইগুলাতো লাগবোই।
বড় রকমের একটা ধাক্কা খেলাম সেদিন…মাত্র এতোটুকুই চাওয়া ৭০ টা বসন্ত পার করা এই বৃদ্ধের! এই সামান্যতেই জীবনে সুখ আসবে তাঁর!
আমি কি আর অতো ভালো মানুষ…বিশ্বাস তো কমে গেছে মানুষের উপর…তাই টাকা দিব না বলে ঠিক করলাম…ঈদের বন্ধ শেষ হল…তফাজ মিয়াকে ঠিক ৩ দিন পর ফোন দিতে বলেছিলাম…৩ দিন পর ফ্ল্যাক্স, ৬ টি কাপ, ছোট একটা প্লাস্টিকের বালতি আর স্প্রে কিনে দেয়া হল।
তারপর থেকেই পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ তফাজ মিয়া…আমার কাছ আউটডোরে এসেছিলেন সেদিন…বড় সখ ফ্ল্যাক্স ভরে চা এনে আমাকে খাওয়াবে…আমি কথাও দিলাম…যাওয়ার আগে, মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়া দিলেন। কন্ঠটা বেশ ভারী হয়ে গেছে তাঁর…সে ভার আমার গলায় এসেও বিঁধল। গলার জড়তা ভেঙ্গে অনুরোধ করলাম, আমার সন্তানদের জন্য দোয়া করবেন।
তফাজ মিয়া চলে গেলেন। সেকেন্ডের মধ্যেই আবার রুমে ঢুকে অপারাধীর মত হাত কচলিয়ে জানতে চাইলেন, বাবাজি, আমি কি সিগরেট বেচতে পারুম? আমি উত্তর দেবার আগেই আবারো বললেন, না মানে, আপনি তো ডাক্তার…আমারে এতো বড় রহম করলেন…তাই আপনার অনুমতি না নিয়া সিগরেট বেচি ক্যামনে!
আমি বললাম, শোনেন বাবাজি। বেঁচে থাকাটাই সবচেয়ে বড় সত্য। বাকী সব মিথ্যা। যান বেঁচেন।
তফাজ মিয়া চলে গেলেন। আমি চেয়ারে হেলান দিয়ে…চোখ বন্ধ করে জীবনে সুখের সংজ্ঞা খোঁজায় মনোযোগী হলাম।
—————————-
পাদটীকাঃ ধনী গরিব, মোটা, শুকনা সবারই হার্ট এ্যাটাক হতে পারে। বুকের ঠিক মাঝখানে চাপ চাপ ভাব, শ্বাসকস্ট, সাথে ঘাম হলে বুঝতে হবে তিনি হার্ট এ্যাটাকের দিকে যাচ্ছেন।
Visits: 2