ফেলী

0 ১০২

ক্লাস ফোরে পরিচয় হয়েছিলো তার সাথে।দুরন্ত এক মেয়ে…একই সাথে ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়েছিলাম।এই পাঁচ বছরে তার সাথে বড়জোর টুকটাক কথা হতো।কখনো অন্তরঙ্গভাবে মেশার সুযোগ হয়নি।অামার ডানে বামে তখন ক্লাসের ভালো রেজাল্টধারী মেয়েদের উঠাবসা। ফেলীর সাথে বসার সুযোগ কোথায় অামার?
অার অন্যরাই বা ওকে কেন মিশতে দিবে অামার সাথে? ও তো বাউন্ডুলে,ঝগড়াটে,দস্যি একটা মেয়ে! ক্লাসে কোনদিন পড়া করে অাসে না।অাজ অমুকের গাছের অাম চুরি,কাল পাড়ার পিচ্চি ছেলেকে ধোলাই,তারপরদিন কুল পাড়তে গিয়ে গাছ থেকে পড়ে পা ভাঙা,এগুলো ছিলো ওর নিত্যদিনের কাজ।

শহরে জন্ম অামার…তবে ওই প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশ সহপাঠীই ছিলো গ্রামের ছেলে মেয়ে। তখন অামার চারদিকে নতুন জগৎ তৈরি হওয়ার সময়।অাকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে ভালো লাগে,স্যার যখন পড়ান তখন স্যারের দিকে না তাকিয়ে ক্লাসরুমের জানালা দিয়ে অাদিগন্ত সবুজ ধানক্ষেত দেখতে ভালো লাগে…।হয়তো উচ্ছল ছেলে মেয়েদের মাঝে একটু গুরুগম্ভীরই ছিলাম।চুপচাপ…শান্তশিষ্ট…!
অপরদিকে ফেলী ছিলো একটা টর্নেডো! কিন্তু তারপরও কেন জানি ওর অস্থিরতা,খামখেয়ালীপনা কখনো খারাপ লাগতো নাহ।
ক্লাস সিক্সে ওঠার পর দেখা গেলো…দুরন্ত ফেলী অারও দুরন্ত হইয়াছে।কারও ধার ধারেনা…মুখ ভর্তি পান, সারাক্ষণ চপচপ করে চাবাইতেছে!ক্লাসরুমের এখানে ওখানে শুধু পানের পিক! সবাই ওর ভয়ে তটস্থ। কেউ কিছু বললে তার গায়ে একশো অাশি কিলোমিটার বেগে পানের পিক ছুড়ে দিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করবে না।

একদিন সকালে ক্লাসের বিরতিতে সবাই যার যার মতো গল্প করছে।এমন সময় ফেলী পান খেতে খেতে অামার কাছে এসে বললো, অামি একটা গান শোনাবো…শুনবে(এই মেয়েটা কেন জানিনা,অামাকে পছন্দ করতো খুব।)?
অামি বেশ চমৎকৃত হয়ে বললাম, শোনাও।
বলামাত্রই ও চিৎকার করে গলা উঁচিয়ে গাইতে থাকলো,
“অাজকালকার ছেলেরা দুষ্টু লম্পট,
অাজকালকার ছেলেরা মেয়ে দেখলে করে ছটফট…..!”
ততক্ষণে ভীড় জমে গেছে বেশ!গান শুনে সবার মাঝে হাসির হুল্লোড় পড়ে গেছে..!
ও সবার মাঝে ঘোষণা দিলো,”গানটা অামি নিজেই বানিয়েছি।সুন্দর নাহ? ”
একথা শুনে অারেক দফা হাসির বন্যা বয়ে গেলো..!

ওর দস্যি মনটার ওপারে একটা সহজ সরল বাচ্চা মানুষ ছিলো।
একদিন জোর করে ওদের বাড়িতে নিয়ে গেলো।ওদের বাড়িতে গিয়েতো অামি অবাক।অাঙ্কেল বেশ শিক্ষিত। গ্রামের মধ্যে দোতলা ফ্ল্যাট বাড়ি!ওর পোশাক অাশাকে কখনোই বোঝা যেতনা,ও অবস্থাসম্পন্ন ঘরের মেয়ে! পানের হাজারো পিকের দাগে ওর সাদা স্কুলড্রেস লাল হয়ে যেতো!মানুষের গাছ থেকে এটা ওটা চুরি করতে গিয়ে ওর জামার এখানে ওখানে ছেঁড়া ছিলো!সবাই দূর দূর করতো ওকে..!
যাই হোক,টাশকি খেয়ে ধাতস্থ হতে সময় লেগেছিলো বেশ কিছুক্ষণ।এরপর অাবারো টাশকি খেলাম…! অামাকে নিয়ে যাবে বলে ওর মাকে অাগের দিনই পিঠা বানাতে বলেছে!অাম,পেয়ারাসহ হরেক রকম খাবারের অায়োজন!

অবাক হয়ে দেখছিলাম,একটি কিশোরী মেয়ের ভালোবাসার প্রকাশ!

মেয়েটি বড় অালভোলা ছিলো বটে,কিন্তু সে অামাকে অালভোলা হওয়ার সুযোগ দেয়নি।এখনও কাঁচা অামের সিজনে মনে হয়,ওই বুঝি কারো গাছের অাম চুরি করে ফেলী দৌড়ুচ্ছে…ভো দৌড়…!
এই এখনই বোধয় জোর করে পাকা তেতুল হাতে গুজে দিয়ে বলবে,”তোমার জন্য পাড়ার দাদার গাছ থেকে পেড়ে এনেছি।কেউ দেখেইনি।”
এখনও মাঝ রাত্তিরে ঘুমের মধ্যে পানের পিক ফেলতে ফেলতে মেয়েটা অামার স্বপনে অাসে।
ক্লাস এইটের পর অার কখনো দেখা হয়নি ওর সাথে…।নয় বছর পেরিয়ে গেছে! অথচ কি অফুরন্ত উচ্ছলতা নিয়ে বুকের গহীনে মেয়েটির দস্যিপনার ছবি এখনো লুকিয়ে রেখেছি অামি…!এখনো ওর পানের উৎকট গন্ধে চারদিকটা কী পরিমাণ মৌ মৌ করে অামার, মেয়েটি কি তা কখনো জানবে?

Visits: 3

মন্তব্য
Loading...
//soocaips.com/4/4139233