অস্তিত্বের ধূম্রজালে

0 ১০৫

নিগার আজ শ্বশুর বাড়িতে বেড়াতে এসেছে ।চারদিকে মহা উৎসব,ধুমধাম ।গ্রামে আজ একটি বিয়ের অনুষ্ঠান ।এখানে বিয়ের অনুষ্ঠানগুলো অত্যন্ত জমজমাট ও উৎসবমূখর হয় এবং যেকোনো অনুষ্ঠানে গোটা গ্রাম একসাথে মেতে উঠে । বিয়ের অনুষ্ঠানে হলুদ মেহেদী থেকে শুরু করে বৌ-ভাত পর্যন্ত গ্রামের ছোট -বড় সবাই খুব আনন্দ করে ।নিগাররাও সে দাওয়াতেরই অংশ ।নাছোড়বান্দা তাই এতদূর থেকে ছুটিছাটা ম্যানেজ করে আসতেই হল।

আজ বৌ-ভাত।ফুল ফ্যামিলি দাওয়াত।বাড়িতে রান্না -বান্নার ঝামেলা নেই ,তাই নিগার ওর শাশুড়িসহ একটু আগেই বিয়ে বাড়িতে পৌঁছাল।
এখনো দাওয়াতের লোকজন আসেনি কিন্তু তাদের কাছের লোকজন দিয়ে বাড়িটা ভালই জমজমাট ।প্রতিটি ঘরই মোটামুটি লোকে লোকারণ্য।ওদেরকে একটি রুমে বসতে দেয়া হল যেখানে বয়স্কা মহিলাদের বসার ব্যাবস্থা ।কয়েকজন বোন-ভাবী গোছের যারা পর্দা করেন তারাও এই রুমেই বসে আছেন ।শাশুড়ি তার সমবয়সী আত্মীয়দের সাথে খোশ গল্পে ব্যাস্ত হয়ে পড়লেন।নিগার ও ভাবী- বয়সীদের সাথে কুশল বিনিময় করে জিগ্যেস করল: বৌ কোথায় ?
একজন বলল:বৌ পাশের ঘরে ।
ও বলল:ভাবী আপনারা এখানে বসে আছেন কেন ?চলেন বৌ এর কাছে যাই ।বিয়ে বাড়িতে বৌ ই তো আসল আকর্ষণ ,আর আপনারা কিনা বৌ এর কাছে না যেয়ে অন্য ঘরে চুপমেরে বসে আছেন !!চলেন…চলেন…।সে ব্যাস্ত হয়ে বলল।
উনারা বললেন :আপনি যান,আমরা যাবনা;বাইরে ছেলে মানুষ আছে ,তাছাড়া বৌ এর ঘরে যাওয়ার অবস্থা নেই………। আপনিই যান….. ।
নিগার কতক্ষণ চুপচাপ বসে রইল আর থাকতে না পেরে বলল: যাই একটু ঘুরে আসি দেখি কীভাবে বৌকে সাজাচ্ছে?
সে বুঝতে পারলনা বোরখা পড়া থাকলে কি করে পর্দার ক্ষতি হবে ?তাকে কেউ এগিয়ে দিয়ে গেলনা,দু’তিনটে রুম পার হয়ে রঙিন পর্দা দেয়া একটা রুম দেখে সে বুঝতে পারল এটাই বৌ এর ঘর তাছাড়া ভিতর থেকে হাসির উচ্চ কলরোল,মিউজিকের আওয়াজ ভেসে আসছে ।
বৌয়ের রুমের আশেপাশেও অনেক মহিলা ও মেয়েরা অত্যাধুনিক সাজে সজ্জিত হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে ।এরা পোশাক -আশাক ,শাড়ী-গয়না,সাজ-সজ্জার পিছনে যেন শরীর দেখাতে ব্যস্ত ।ভিডিও ম্যানরা এদের পিছনেই দৌড়াদৌড়ি করছে ।

নিগার অবাক হল :”এক পক্ষ পর্দা নষ্ট হওয়ার ভয়ে বোরখা পড়েও ঘর থেকে বের হচ্ছে না অন্য পক্ষ নামে মাত্র পোশাক পড়ে ভিডিও ম্যান দের সামনে বিভিন্ন এংগেলে পোজ দিতে দ্বিধা তো দূরে থাক তৃপ্তিতে গদগদ হচ্ছে ।”

সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে সে বৌয়ের ঘরে ঢুকল ।এখানেও একই অবস্থা ….সো কলড মডার্ন গুলো বৌ কে ঘিরে আছে ।ওরাই বৌকে সাজাচ্ছে আর হাজারো দিক নির্দেশনা দিচ্ছে ।নিগার কে দেখে ওরা যেন একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেল যে এই হিজাবধারী আবার আমাদের মাঝে কেন ?হিজাবধারীদের জায়গা তো অন্য ঘরে ।সাথে সাথে আছে ঔদ্ধত্য ভাব এবং হিজাবধারীরা বড্ড সেকেলে এবং আকাট মূর্খ তা বোঝানোর আপ্রাণ চেষ্টা ।

নিগার একটি মেয়েকে চিনতে পারল যে তাকেও চিনে …নিগার ইউনিভার্সিটির উচ্চ শিক্ষিতা এবং সরকারি কলেজের শিক্ষিকা সেটা সে জানে কিন্তু মেয়েটি তাকে দেখেই না চেনার ভান করে সরে যেতে লাগল….।
নিগার বুঝতে পারল সে তাদের ছন্দে পতন ঘটিয়েছে ।কোথায় যেন একটা সুর কেটে গেছে যা তাঁর একার পক্ষে জোড়া দেয়া সম্ভব নয়।
তাই সে সেখান থেকে বের হয়ে আসল এবং পূর্বের জায়গায় ফিরে গেল ।সে দেখল এই মজলিশের মহিলা গুলো ঐসব বেপর্দা মেয়েদের সম্পর্কে বিভিন্ন মুখরোচক কথা-বার্তা বলছে।কিন্তু ওদের কাউকে আশেপাশে দেখলে আবার চুপ করে যাচ্ছে ।

সে কিছুক্ষণ বসল কিন্তু ইলেকট্রিসিটি না থাকায় এবং মানুষের ভিড়ে ,অসহ্য গরমে নিগার আর থাকতে পারল না ….যেন তাঁর দম বন্ধ হয়ে আসছে ।সে তাড়াতাড়ি উঠে শাশুড়ি কে বলল :আম্মা আমি বাইরে যাব।শাশুড়ি বলল: বাইরে তুমি একা একা কোথায় যাবে ?নিগার বলল :আমি জানিনা,আম্মা আমি বাইরে যাব।আমি এখানে এভাবে বসে থাকলে দম বন্ধ হয়ে মারা যাব।
একথা শুনে পর্দানশীলা ভাবীরা ফোড়ন কাটতে লাগল…..ভাবী ঐসব মেয়েদের মতো হয়ে গেছে নাকি ??এহ্!!স্বাধীন হয়ে গেছে !!

নিগার আর নিজেকে সামলাতে পারলনা ।বলল: আমরা স্কুল ,কলেজ ইউনিভার্সিটিতে সর্বত্র হিজাব পড়েই চলাফেরা করেছি ,ভালো ভালো রেজাল্ট করেছি,সেমিনার -সিম্পোজিয়াম করেছি এখনো একটি কলেজে চাকরি করছি এই হিজাব পড়েই এখানে স্বাধীন হওয়ার কি হল?? হ্যাঁ ,আমরা ইসলাম এইভাবে পালন করিনি যে প্রয়োজন হলেও ঘরের কোণায় লুকিয়ে বসে থাকতে হবে !!

অগত্যা ওর শাশুড়ি একটি ছোট মেয়েকে ওর সাথে দিলেন ,সে ঐ মেয়েটিকে নিয়ে বাড়ির পিছনে যেখানে আম-কাঁঠালের গাছ ,বাঁশ ঝাড় আর আদিগন্ত খোলা আকাশ দেখা যাচ্ছিল সেখানে এসে থামল ।এক ঝলক ঠান্ডা বাতাস এসে মুখে ঝাপটা মারতেই সে যেন প্রাণ ফিরে পেল ।সে গুনগুন করে গান গাইতে লাগল….পছন্দের কবিদের কবিতার লাইন আওড়াতে লাগল..মনে মনে দু’চারটি কবিতার লাইন ও সাজিয়ে ফেলল।অদ্ভুত সুন্দর আল্লাহর সৃষ্টির অপরূপ সৌন্দর্য গুলো ক্যামেরা বন্দি করতে করতে ভাবতে লাগল: “আমাদের গোটা দেশের পরিস্থিতি আজ এমনটিই ….এই দুই ভাগে বিভক্ত আমাদের সমাজ ব্যাবস্থা ।যারা ইসলাম মানছে ওরা শিক্ষা -দীক্ষা ,সংস্কৃতিতে এগুচ্ছেনা আবার যারা শিক্ষা -দীক্ষা ,সংস্কৃতিতে নিজেদের এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তারা ইসলামকে এক ঝটকায় দূরে ছুড়ে ফেলছে ।
কিন্তু ইসলামের বিধানগুলো পালন করেও যে শিক্ষা -দীক্ষা ,সাহিত্য -সংস্কৃতি ,প্রযুক্তি সবকিছুতে অগ্রসর হওয়া যায় এটা যেন এরা বুঝতেই পারছে না ।যারা বুঝে তাদের সংখ্যা নিতান্তই কম।ইসলাম আর আধুনিকতার মধ্যে দ্বন্দ্ব দিনকে দিন যেন বেড়েই চলেছে ।যখন থেকে সে এই গ্রামের বৌ হয়েছে তখন থেকে তার জীবনেও দুই এক্সট্রিম সাইডের ধাক্কা পড়েছে ।বস্তুত : ইসলাম ও আধুনিকতার মধ্যে দ্বন্দ্ব কোনকালেই ছিল না আজও নেই ”।

এই মানুষগুলোর জন্য নিগারের খুব আফসোস হতে লাগল,যারা আধুনিক ওরা ইসলামের সৌন্দর্য বুঝলনা আর যারা ইসলামমনা ওরা আধুনিকতার সুবিধাগুলো উপভোগ করতে পারল না ।
নিগার আশায় থাকল এরপরে যখন সে এই গ্রামে কোন বিয়ের অনুষ্ঠানে আসবে, সে তার মতো আরো কিছু মানুষ পাবে যখন একা বলে আর তাকে সরে আসতে হবেনা ……..।

Visits: 7

মন্তব্য
Loading...
//glaikrolsoa.com/4/4139233