যেখানে সুখ আছে
২০০৬ বা ২০০৭ সময়টা ঠিক এমনটিই হবে একটি ওয়ার্ল্ড সার্ভের রিপোর্টে বিশ্বের সবচেয়ে সুখী দেশ হিসেবে বাংলাদেশের নাম এবং সবচেয়ে সুখী শহর হিসেবে রাজশাহী শহরের নাম উল্লেখ করা হয়। যেহেতু আমার বাড়ি বৃহত্তর রাজশাহী অঞ্চলে এবং রাজশাহী বিশ্ব বিদ্যালয়ের ছাত্রী হওয়ায় ঐ সময় রাজশাহীতেই থাকতাম স্বভাবতই এই খবরটি পড়ে খুব খুশি হয়েছিলাম ।কারণ এই সুখী মানুষগুলোর দলভুক্ত আমিও একজন ।
তো পরদিন ছিল শ্রদ্ধেয় প্রফেসর দিলীপ কুমার নাথ স্যারের ক্লাস । তিনি আমাদের Socialism & socialistic development কোর্সটি পড়াতেন। তিনি ডিপার্টমেন্টের প্রবীণতম শিক্ষকদের একজন এবং সবসময় ক্লাসে অত্যন্ত জ্ঞানগর্ভ আলোচনা রাখেন । সেদিন স্যার ক্লাসে এসেই বললেন : গতকালকে একটি সংস্থা কর্তৃক এক জরিপে আমাদের দেশকে বিশ্বের সবচেয়ে সুখী দেশ এবং আমাদের এই রাজশাহীকে গোটা ওয়ার্ল্ডের মধ্যে সবচেয়ে সুখী শহর/এলাকা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে তোমরা কি সেটা জানো?? সবাই সমস্বরে বলল: জ্বী স্যার জানি।
স্যার বললেন 3rd world এর একটি দেশ আমাদের দেশ যেখানে মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকের কাছাকাছি জনগণ দারিদ্র সীমার নীচে বাস করে সে দেশের জনগণ কীভাবে সবচেয়ে সুখী হতে পারে ?আসলে আমাদের দেশের Mass people উন্নত বিশ্বের Life leading systems সম্পর্কে কোন আইডিয়া রাখেনা বলেই ওরা নিজেদের যাপিত জীবন নিয়ে খুশি এবং সুখী ।Developed country তে একজন মানুষ কতটা সুযোগ সুবিধা পায় আর কতটা High class life lead করে তার কিছুই এরা জানেনা তাই নিজেদের কে খুব সুখী মনে করে আর তারমধ্যে এই রাজশাহী অঞ্চলের লোকগুলো আরেকটু বেশি যে কারণে গোটা ওয়ার্ল্ডের মধ্যে সবচেয়ে সুখী মানুষের তালিকায় এদের নামটি সবার প্রথমে উঠে এসেছে ।সত্যিকার অর্থে এই জরিপে প্রকৃত সুখের স্বরূপ ধরা পড়েনি …….।
স্যারের কথা শুনে মনটা এক নিমেষেই খারাপ হয়ে গেল আর মনে হল সত্যি আমার দেশের এবং আমার এলাকার লোকগুলো এতটাই সহজ সরল যে নিজেদের যা আছে তাই নিয়েই খুব সুখী , প্রকৃত সুখ কাকে বলে সেটাই তো এরা জানেনা , আবার সবচেয়ে সুখী !! এগুলো আমাদেরকে নিয়ে তামাশা ছাড়া আর কি??
এভাবেই বেশ কয়েকটি দিন চলে গেল ।ক্যাম্পাসে থাকাকালীন সময়ে খোদ রাজশাহী অঞ্চলের সাধারণ লোকদের জীবন যাপন কাছে থেকে দেখার সৌভাগ্য আমার খুব একটা হয়নি ।কিন্তু ২০০৮ সালের মাঝামাঝিতে আমার বিয়ে হয় রাজশাহীতে ।রাজশাহী জেলার অন্তর্গত একটি থানায় ।সদর থানা থেকে চার – পাঁচ কিলোমিটার দূরে ।আর এর ফলে আমি রাজশাহীর সাধারণ কিছু লোকজনের জীবন যাপন কাছে থেকে দেখার সুযোগ পাই ।
এক সন্ধ্যায় বেড়াতে গিয়েছিলাম আমার হাজবেন্ড এর দু:সম্পর্কের এক ভাই-ভাবির বাড়িতে । ভাই-ভাবি তাকে খুব ভালবাসে । বললো: চলো ঘুরে আসি । আর আমিও সাথে সাথে রাজী । কারণ নতুন জায়গা নতুন মানুষ সম্পর্কে জানতে আমার বেশ ভালোই লাগে ।তাই দেরি না করে বের হয়ে পড়লাম ।
বাড়িটা কাছেই ….কয়েকটি বাড়ি পাড় হতেই ওনাদের বাড়ি দেখা গেল ।বাইরে থেকে দেখেই বাড়িটা আমার ভালো লেগে গেল । চারদিকে মাটির মোটা প্রাচীর দিয়ে বাড়িটা ঘেরা। প্রাচীরের মাঝখানে একটু উঁচুতে টিনের তৈরি দরজা যা বেশ মজবুত ।দরজার নীচে মাটি কেটে করা দুটি সিঁড়ি ।প্রাচীরের তিন দিকেই উপরে টিনের ছাউনি দেয়া ।যে পাশে থাকার ঘর সেদিকে দোচালা উঁচু ছাউনি আর বাকি দুপাশে একচালা ছাউনি । উপরে এই ছাউনি থাকাতে মাটির সিঁড়ি বৃষ্টিতে নষ্ট হতে পারে না ।আমরা ভিতরে ঢুকলাম ।ভিতরে ঢুকে আমি কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম , মাটির বাড়ি এতটা সুন্দর কি করে হয়??
একধারে প্রাচীর বেয়ে উঠে গেছে সন্ধ্যা মালতী গাছ ।ফুলে ফুলে প্রাচীরের উপরটা ছেয়ে আছে ।সুন্দর নিকানো উঠোন ।তারই একপাশে দুটি মাটির পাত্রে
লাগানো ঘাষফুল ঘন হয়ে বিছিয়ে আছে ।আর ছোট ছোট অসংখ্য ফুল ফুটে সেখানে লাল সবুজের এক অপূর্ব দ্যোতনা সৃষ্টি করেছে ।একদিকে রান্না ঘর সুন্দর পরিপাটি করে সাজানো ।টানা বারান্দার একপ্রান্তে এক জায়গায় মশারি টানানো, যার ভিতরে একটি গো-বৎস মনের সুখে জাবর কাটছে ।গোটা বাড়ি জুড়ে মায়াবী কোনো হাতের অপার যত্নের ছাপ স্পষ্ট হয়ে ফুটে আছে ।
আমাদের আওয়াজ পেয়ে ঘর থেকে প্রথমে ভাই বের হয়ে আসলেন ।মাথায় টুপি ,তিনি মসজিদের উদ্দেশে বের হচ্ছিলেন ।শশ্রুমন্ডিত মুখ ,আপাদমস্তক একজন বিশ্বাসী মানুষের প্রতিচ্ছবি ।হাসিখুশি মুখ,নিতান্তই সহজ সরল ।আগেই গল্প শুনেছিলাম ভাইয়ের অবস্থা খুব একটা ভালোনা ।৪/৫ কাঠা জমি আর বাড়ির ভিটা মাটি টুকু ছাড়া তার তেমন কিছুই নেই তাই পাঁচ সদস্যের সংসার চালাতে তাকে অন্যের জমিতেও কাজ করতে হয়।
এরপর ভাবি বের হয়ে আসলেন ,গা – মাথা সুন্দর করে ঢাকা ,গাল ভরা হাসিমুখ নিয়ে ।ভাবীটার গায়ের রং বেশ চাপা কিন্তু তার মুখের অকৃত্রিম ,উচ্ছল হাসিতে সব ঢাকা পড়ে গেছে । আমার কাছে মনে হল জীবনে আমি এত সুন্দর মানুষ কখনো দেখিনি ,আমি উপলব্ধি করলাম মানুষের দু:খ ,কষ্ট ,অতৃপ্তি যেমন প্রখর সৌন্দর্য কে ম্লান করে দিতে পারে উল্টোদিকে তা সৌন্দর্য সৃষ্টিও করতে পারে ।
আমি সুখী এই দম্পতিকে দেখছি আর ভাবছি এদের কি আছে ?কিছুই তো নেই তারপরও এই বাড়ির প্রতিটি পরতে পরতে যেন সুখেরা লুটোপুটি করছে ।আর এতগুলো দিন পর আজ……..হ্যাঁ আজ …..আমি বললাম :দরকার নেই আমাদের দেশের এইসব সহজ সরল মানুষদের Developed country সম্পর্কে ধারণা নেয়ার ।থাকনা ….এই মানুষ গুলো এমনই সহজ সরল হাসি খুশি …এদের মুখের এই উচ্ছল হাসির খোঁজ Developed country এর কয়জন লোক পেয়েছে??
Visits: 2