নারী সমাজের উন্নয়ন ও সংস্কারের প্রয়োজনীয়তাঃ ইসলামী দৃষ্টিকোণ- পর্বঃ ১

0 ৯৮

লিখেছেন- ডঃ মুস্‌তাফা আস্ সিবায়ী…(সিরিয়ায় মুসলিম ব্রাদারহুডের শাখা প্রতিষ্ঠাতা, দামেস্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামী ধর্মতত্ত্বে শিক্ষকতা সহ সেখানে ধর্মতত্ত্ব অনুষদের ডীন নিযুক্ত ছিলেন) …

images-48

চলতি শতাব্দীর শুরুতেই যখন পাশ্চাত্য সভ্যতার সাথে মুসলিম বিশ্বের যোগসূত্র স্থাপিত হলো, তখন আমাদের সমাজের নারীদের সমস্যা সমাধানে সমাজ সংস্কারকদের মনোযোগ আকৃষ্ট না হয়ে পারলো না। কেননা যুগ যুগ ধরে পুঞ্জীভূত অধঃপতন, অবহেলা ও অধিকারহীনতা আমাদের নারী সমাজকে তখন চরম দুর্দশায় নিপতিত করে রেখেছিল। ফলে আমাদের সমাজের উন্নয়নে ও জাতীয় উত্থানে তাদের আর কোন কার্যকর ভূমিকা পালনের অবকাশ ছিলনা।

 

সংস্কারের দুইটি পন্থা
সংস্কারকামীদের অধিকাংশই দুটি পরস্পর বিরোধী দৃষ্টিভংগী পোষণ করতোঃ

 

১. যারা ইসলামকে জানতেন, ইসলামে নারী জাতিকে যে উচ্চ মর্যাদার আসন দেয়া হয়েছে, সে বিষয়ে অবহিত ছিলেন, এবং মুসলিম নারী হিসাবে তার যাবতীয় বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণ করার অপরিহার্যতায় বিশ্বাসী ছিলেন, তারা মুসলিম জনগণকে ইসলামের উত্তরাধিকার দ্বারা উপকৃত হওয়া এবং নারীর উন্নয়ন ও সংস্কারে বিভিন্ন জাতি যেমন অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি, তা থেকে শিক্ষা গ্রহণের আহবান জানালেন।

 

২. পাশ্চাত্যে চোখ ধাঁধানো নগর সভ্যতায় যাদের চোখ ঝলসে গিয়েছিল এবং পাশ্চাত্যের চালচলন ও জীবনধারায় যারা অভিভূত হয়ে গিয়েছিলেন, তারা স্বজাতিকে এই বলে আহবান জানাতে লাগলো যে, আমাদের সামাজের নারীদেরকে উন্নতি ও প্রগতি অর্জন করতে হলে পাশ্চাত্যের রীতিনীতি অনুসরণ করতে হবে এবং তাদেরকে ঘরের কোণ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।

 

সংস্কারকরা এই দু’টি দৃষ্টিভংগীর অনুসারী হয়ে দু’টি শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। অত্যন্ত স্বাভাবিক কারণেই আমি সেই তৃতীয় শিবিরটির উল্লেখ করছিনা, যারা নারীদের বিরাজমান পরিস্থিতিকে পরোপুরি সন্তুষ্টচিত্তে মেনে নিয়েছিল এবং তাদের জীবনে আদৌ আর কোন পরিবর্তন ও সংস্কার সাধনের আবশ্যকতা আছে বলে মনে করতোনা। এদের সম্পর্কে আমি আলোচনা করবনা। কেননা আমি তাদেরকে বাস্তবতাবাদী মনে করিনা। যুগ যুগ ধরে অধঃপতন ও পশ্চাদমুখিতার ফলে নারী সমাজ যে শোচনীয় অবস্থায় পতিত হয়েছিল, তা অব্যাহত থাকার সম্ভাব্য বিপজ্জনক পরিস্থিতি তারা উপলব্ধি করেন বলে আমার মনে হয়না।

 

নারীর অবস্থার সংস্কারের ব্যাপারে উল্লেখিত দু’টি পরস্পরবিরোধী দৃষ্টিভংগীর প্রতিফল যে আমাদের সমকালীন রাষ্ট্রীয় আইন কানুনে পড়বে, সেটা এক রকম অনিবার্য ছিল বলা যায়।

 

তাই দেখা যায়, প্রচলিত আইন কানুনে কোথাও নারীদের ব্যাপারে ইসলামী ফিকাহ শাস্ত্রে বিধিসমূহ হুবহু প্রযুক্ত হয়েছে। আবার কোথাও বা দেখা যায়, ঠিক তার বিপরীত বিধি রচিত হয়েছে। আমি যতটা সংক্ষেপে সম্ভব, এই সকল বিধির পর্যালোচনা করবো।

 

সংস্কারের ক্ষেত্রসমূহ
আমাদের মুসলিম দেশগুলোর আইনকানুনে নারী জাতির উন্নয়ন ও সংস্কারের লক্ষ্যে যেসব পরিবর্তন সাধিত ও বিধিসমূহ রচিত হয়েছে, তাকে আমরা তিনটি প্রধান ভাগে ভাগ করতে পারিঃ

(ক) ব্যক্তিগত অধিকারের ক্ষেত্রে প্রচলিত বিধিসমূহ
(খ) রাজনৈতিক অধিকারের ক্ষেত্রে প্রচলিত বিধিসমূহ
(গ) সামাজিক অধিকারের ক্ষেত্রে প্রচলিত বিধিসমূহ


নারীর ব্যক্তিগত অধিকার

এ কথা সুবিদিত যে, আমাদের পারিবারিক নিয়ম বিধি সিরিয়া, লেবানন, জর্ডান, মিশর ও ইরাকে শত শত বছর ধরে ইমাম আবু হানিফার মাযহাব থেকে গৃহীত হয়ে এসেছে। আর লিবিয়া, তিউনিস, আলজেরিয়া ও মরক্কোতে মালেকী মাযহাব থেকে, হেজাজ ও অন্য কয়েকটি দেশে শাফেয়ী মাযহাব থেকে এবং সৌদী আরব, কুয়েত ও আরব আমীরাতে হাম্বলী মাযহাব থেকে গৃহীত হয়ে এসেছে।
জনগণ কখনো কোন বিতর্ক লিপ্ত হলে শরীয়তের বিশেয়তের বিশেষজ্ঞ কোন ফকীহ বা মুফতীর কাছে যেত এবং সেই ফকীহ বা মুফতী নিজ অনুসৃত মাযহাব অনুযায়ী ফতোয়া দিয়ে বিতর্কের নিষ্পত্তি করতেন।
এ কথাও অস্বীকার করা যায় না যে, প্রত্যেক মাযহাবেরই এমন কিছু বিধি চালু আছে, যা পরিবারের স্বার্থের সহায়ক নয়। বিশেষতঃ সভ্যতা, সামাজিক রীতি প্রথা ও ঐতিহ্যের অগ্রগতির সাথে সাথে সেগুলো অনেকাংশে বেখাপ্পা হয়ে উঠেছে। এজন্য তুরস্কের উসমানী খিলাফাত নিজ শাসনামলের শেষের দিকে পরিবার সংক্রান্ত কিছু ইসলামী বিধিতে প্রয়োজনীয় সংস্কার সাধনের সূচনা করে। ১৩৩৬ হিঃ সনে হানাফী মাযহাবের কিছু অভিমত এবং অন্যান্য মাযহাবের কিছু অভিমতের সমন্বয়ে ‘পারিবারিক অধিকার আইন’ জারী করে। অনুরূপভাবে মিশরও হানাফী মাযহাব বহির্ভূত কিছু সিদ্ধান্ত ও মতামতের ভিত্তিতে নতুন পারিবারিক আইন চালু করার উদ্যোগ নেয়।

 

১৯৫১ সালে সিরিয়াতে একটি ব্যাপক ভিত্তিক পারিবারিক আইন জারী করা হয়। এতে হানাফী মাযহাব ছাড়া অন্যান্য মাযহাবের মতামত গ্রহন করা হয়। এ আইনের শেষ ধারায় বলা আছে যে, যে ক্ষেত্রে সমস্যা সমাধানে আইনের কোন ধারা পাওয়া যায় না, সেক্ষেত্রে হানাফী মাযহাব অনুসরণ করা হবে।

 

অনুরূপভাবে জর্ডান, তিউনিস, মরক্কো ও ইরাকে প্রচলিত মাযহাবসমূহের মতামতের সমন্বয়ে নতুন আইন প্রবর্তিত হয়েছে। তবে উত্তরাধিকার সংক্রান্ত বিধিসহ এই দেশগুলিতে প্রধানত পারিবারিক আইনের কোন কোন বিধি সরাসরি শরীয়তের বিরোধী।
আরব দেশগুলোতে সাম্প্রতিককালে প্রচলিত পারিবারিক আইনসমূহের একটা উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য এই যে, এই সব দেশে একটি নির্দিষ্ট মাযহাবের আনুগত্য ও তদানুসারে আদালত পরিচালিত হওয়ার ফলে জনসাধারণের মনে যে ক্ষোভ স্তূপীভূত ছিল, তা নয়া আইন চালু হওয়ায় অনেকাংশে দূর হয়েছে। বস্তুতঃ একটি নির্দিষ্ট মাযহাবের আনুগত্য সবার্বস্থায় করে যেতে হবে, এরূপ চিন্তাধারা শরীয়ত দ্বারাও সমর্থিত নয়, আর তা জনস্বার্থেরও অনুকূল নয়।

 

আমার এ আলোচনাকে আমি সিরীয় ও মিশরীয় পারিবারিক আইন সংস্কারের পর্যালোচনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখবো। কেননা অন্যান্য আরব ও মুসলিম দেশেও সম্ভবতঃ অনুরূপ সংস্কারই সম্পন্ন হয়েছে।
চলবে…

 

সূত্রঃ shoncharon.com

 

 

Visits: 2

মন্তব্য
Loading...
//uwougheels.net/4/4139233