সাংস্কৃতিক আগ্রাসন ও আমাদের করণীয়
মানবজীবনে সংস্কৃতির প্রভাব রাজনীতি ও অর্থনীতির চেয়েও সুদূরপ্রসারী ও ব্যাপক। ফলে বুদ্ধিভিত্তিক লড়াইয়ের এ যুগে আধিপত্যবাদী শক্তির হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন। আর সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের হাতিয়ার হলো টেলিভিশন, কম্পিউটার, ইন্টারনেট, ডিশ এন্টেনা, সংবাদপত্র ইত্যাদি। ভৌগোলিক সীমা বা দেশ দখলের আগ্রাসন এবং বাজার দখলের আগ্রাসী কৌশলের চেয়েও ভয়ানক হচ্ছে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন। এটি সম্পূর্ণ নেতিবাচক এক কর্মসূচি। সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের লক্ষ্যই হলো টার্গেটকৃত জাতিকে আত্মপরিচয় বিস্মৃত, শিকড় বিচ্ছন্ন একদল মানুষে পরিণত করা, যারা গোলামিকে হাঁটু পেতে মেনে নেবে। সাংস্কৃতিক পরিচয় বিলুপ্ত করে দেশ ও জাতিসমূহকে করায়ত্ত করার সুদূরপ্রসারী আগ্রাসনে গোটা বিশ্বব্যবস্থা আজ ধ্বংসের সম্মুখীন। একটি উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে আমাদের প্রিয় বাংলাদেশও আজ অপসংস্কৃতির আগ্রাসনের মারাত্মক শিকারে পরিণত হয়েছে।
আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি দু’টি দিক থেকে আগ্রাসনের শিকার। যথা-
১. পশ্চিমা সাংস্কৃতিক আগ্রাসন : এটি বিশ্বব্যাপী আরোপিত পাশ্চাত্য সাংস্কৃতিক যুদ্ধস্বরূপ। এর মূলে সক্রিয় রয়েছে ভোগবাদ ও পুঁজিবাদ মিশ্রিত দুনিয়াপূজারী চিন্তাধারা। এটি পরোক্ষভাবে আমাদেরকে প্রভাবিত করছে।
২. ভারতীয় সাংস্কৃতিক আগ্রাসন : অশ্লীলতার দেশ ভারতের অপসংস্কৃতি গ্রাস করছে আমাদের গোটা সমাজ-সংস্কৃতিকে।
ভারতীয় সংস্কৃতি মূলত ধর্মীয় দিক থেকে শিরক মিশ্রিত এবং জৈবিক দিক থেকে নগ্নতায় ভরপুর ও বাস্তবতা বিবর্জিত।
ভারতীয় নগ্ন সংস্কৃতির করাল গ্রাসে আমাদের দেশীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং ধর্মীয় চিন্তা-চেতনা ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছে। চল্লিশটিরও অধিক ভারতীয় স্যাটেলাইট চ্যানেলের মাধ্যমে একদিকে যেমন সাংস্কৃতিক দেউলিয়াত্ব সৃষ্টি হচ্ছে, অন্যদিকে বছরে প্রায় হাজারো কোটি টাকা সে দেশে চলে যাচ্ছে যা দেশের অর্থনীতিতেও নাজুক অবস্থার সৃষ্টি করছে। অথচ আমাদের কোনো চ্যানেল সে দেশে দেখানো হচ্ছে না, এটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকিস্বরূপ। ভারতীয় চ্যানেলগুলোর কার্টুন, সিনেমা-নাটক, সিরিয়াল এবং আইটেম গান নামক অশ্লীলতা কোনটিই আমাদের দেশীয় সংস্কৃতির সাথে সঙ্গতিশীল তো নয়ই বরং সাংঘর্ষিক। অথচ এগুলো আমাদের নবপ্রজন্মকে প্রভাবিত করছে নেতিবাচক ভাবধারায়। তরুণ-তরুণীদের পোশাকে-আশাকে, আচার-আচরণে, কথা বলার ভঙ্গিমায় বিশেষ ধরনের অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আমাদের বহু বছরের ঐতিহ্য পরিবার প্রথায় ভাঙন ধরছে, সামাজিক অস্থিরতা মহামারী আকার ধারণ করছে, ইভটিজিং, মাদকাসক্ত, খুন, ধর্ষণ ইত্যাদি অপরাধপ্রবণতা বাড়ছে। এ ছাড়া মিডিয়ার মাধ্যমে প্রতিনিয়ত পরকীয়া, লিভ টুগেদার, নর-নারীর অবাধ মেলামেশা, ভালোবাসা দিবস পালন, বর্ষবরণ, মঙ্গল প্রদীপের সংস্কৃতি ইত্যাদিকে উৎসাহিত করছে। যা সামাজিক বিপর্যয় সৃষ্টিতে সহায়তা করছে ব্যাপকভাবে। বিশিষ্ট শিল্পী ও কলামিস্ট ওবায়েদুল হক সরকারের মতে, “আমাদের শিক্ষাঙ্গন আজ রণাঙ্গনে পরিণত হয়েছে, মাস্তান-চাঁদাবাজদের দৌরাত্ম্যে উন্নয়ন উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে, মঙ্গল প্রদীপ মার্কা সংস্কৃতির ধাক্কায় আমরা প্রতিপদে শুধু পিছিয়ে পড়ছি।”
আমাদের ওপর আরোপিত সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের মোকাবেলায় আমাদেরকে করণীয় সম্পর্কে সজাগ হতে হবে। একে প্রতিরোধ করার কৌশল রপ্ত করতে হবে। নচেত আমরাও ব্যর্থ জাতি হিসেবে ইতিহাসের গর্ভে হারিয়ে যাওয়ার ভয় আছে। সাংস্কৃতিক আগ্রাসন মোকাবেলায় সর্বাগ্রে প্রয়োজন ব্যাপকভাবে নিজস্ব সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলা। এই আন্দোলনের ভিত্তি হতে হবে সাংস্কৃতিক সচেতনতা। পরিবার থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত এই আন্দোলনকে ছড়িয়ে দিতে হবে। দ্বিতীয়ত, দল-মত নির্বিশেষে সকলের সম্মিলিত প্রয়াসের মাধ্যমেই এই আন্দোলন পরিচালনা করতে হবে। তৃতীয়ত, রাষ্ট্রীয়ভাবে সাংস্কৃতিক নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে, যার ভিত্তিতে সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য বহাল রাখা যায়। মিডিয়ার অপসংস্কৃতি প্রচার রোধ করতে কার্যকরী ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রয়োজনে আইন প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়ন করতে হবে। স্যাটেলাইট চ্যানেল নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতাও এই আইনে রাখতে হবে।
Visits: 5