পুতুল খেলা

0 ৯২

রান্না ঘর থেকে পাতিল নাড়ার শব্দ আসছে। এ বাড়িতে বিড়াল নেই। বড় মেয়ে এসেছে বোধ হয়। প্রতিদিন সে এসময়েই স্কুল থেকে আসে। পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। আজকে এসেই রান্না ঘরে ঢুকেছে। ক্ষুধা পেয়েছে নিশ্চয়। সকালে কিছু খেয়ে যায়নি। তাই বাড়ি এসেই সরাসরি রান্নাঘরে ঢুকেছে। তাহিরা ঘর থেকেই পাতিল নাড়ার শব্দ শুনছে। শুন্য পাতিলের শব্দ বেশি। শব্দটি খুব বিরক্তি লাগছে। মেয়ে রান্নাঘর থেকে বের হয়ে ঘরে ঢুকেছে। কাপড়ের বাক্সের উপর বই রেখে বাইরে পিড়িতে পাটি বিছিয়ে শুয়েছে। বাইরে থেকে দুটি প্রাণীর অস্তিত্ব বোঝার উপায় নেই। এই অপরাহ্নে বাড়ির কোথাও কোন কোলহল নেই।

ছোট মেয়েটি অনেকক্ষণ পর বাড়ি ফিরেছে। সে এখনও স্কুলে যায়না। বড় বোনের পাশে বসে তাকে ডাকছে।

-সীমা আপা, ঘুমাচ্ছিস? ওঠ। চল, কিতকিত খেলি।

সীমা উঠে বসেছে। শরীর বেশ দুর্বল। দুর্বল শরীরে কিতকিত খেলতে ইচ্ছে করছে না। রিনাও নিশ্চয় না খেয়ে আছে। ইচ্ছে নেই, তারপরও খেলা উচিৎ।

-কিতকিত না, চল পুতুল খেলি।
-কিন্তু পুতুল নেই যে?
-পাঠকাঠি দিয়ে বানাবো।

সীমা পুতুল বানাই। গরীবের মেয়ে, পড়ালেখায় অনেক ভালো। বড় লোকের ছেলের সাথে একই ক্লাসে পড়ে। দুজনের মধ্যে বন্ধুত্ব হয়। বড়লোকের ছেলেটি মেয়েটিকে তার বাড়ি নিয়ে যায়। সেখানে তাকে গরুর মাংস দিয়ে ভাত খেতে দেয়। মেয়েটির অনেক খেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু লজ্জায় খেতে পারে না। অল্পকরে খাই।
দুজনে পুতুল খেলতে বসে। হঠাৎ পাশের বাড়ির দাদির ডাক আসে।

-এই সীমা, সীমা। তোর মা আছে?
-আছে দাদি।
-একটু ডাকতো।
-আচ্ছা।
তাহিরা চোখ বুজে শুয়ে আছে।
– মা, গোরি দাদি ডাকছে।

তাহিরা উঠে বসলো। শরীর বেশ দুর্বল। ত্রিশ কদম পরেই গোরি দাদির বাড়ি। ধীরে ধীরে সেদিকে গেল। দোতালা বাড়ির নিচ তলার বারান্দায় গোরি বসে আছে।

-চাচি ডেকেছেন?
-হ্যা। কালকের কিছু খাবার ছিল। নষ্ট হয়নি। কিন্তু বাড়ির কেউ খাচ্ছে না। নিয়ে গিয়ে দেখতো খেতে পারিস কিনা।

তাহিরার খুব বলতে ইচ্ছে করছিল, ‘যে কাল থেকে কিছু খাইনি সে যেকোন খাবার খেতে পারে, সুখাদ্য কিংবা কুখাদ্য সব।’ কিন্তু সব কথা বলার নিয়ম নেই। নিয়মের কথাটিই সে বললো।

-দেন। নষ্ট না হলে খাওয়া যাবে না কেন?
-কিছুই হয়নি। তোর ছোট মেয়েটি খেয়ে গেল। মেয়েটি খুব কাজের। অতটুকু মেয়ে পুরো উঠানটি ঝাড় দিল। বিকেলে ঘুম থেকে উঠে দেখি কাউকে কিছু না বলেই ঝাড় দিচ্ছে।

তাহিরা বুঝতে পেরেছে তার ছোট মেয়ে কিতকিত খেলার শক্তি কোথা থেকে পেল। এক গামলা ভাত ও বাটিতে কিছু তরকারি নিয়ে সে বাড়ি ফিরলো। নবীর কাছে ফেরেস্তা খাবার নিয়ে আসতো।আমাদের কাছে ফেরেস্তা আসে না বটে। কিন্তু কিছু কিছু মানুষকেই আল্লাহ ফেরেস্তা বানিয়ে দেন। তাহিরার কাছে গোরি চাচি হচ্ছে সেরকম একটি ফেরেস্তা। ঘুম থেকে উঠে রিনাকে উঠান ঝুড়ু দিতে দেখেই বুজেছে বাড়িতে খাবার হয়নি।যে খাবার সে দিয়েছে তা কালকের না, আজকেরই টাটকা খাবার।

তাহিরা খাবার নিয়ে বসে আছে। মানুষটি সকালে না খেয়ে বের হয়েছে। আর ফেরেনি। ক্ষুধার্থ বউয়ের মুখ দেখা কঠিন, কিন্তু ক্ষুধার্থ মেয়ের মুখ দেখা অসম্ভব। একদিন কাজ থাকলে তিনদিন কাজ থাকে না। একজনের আয়ে সংসার চলে।অন্নাভাব এখানে অতিথি হয়ে আসে না, সংসারের অংশ হয়েই আছে। ছোট মেয়ে রিনাকে পাঠিয়েছে তাকে ডাকতে।সীমা পাশে বসে খাচ্ছে।

-মা, খাবে না?
-তোর বাবা আসুক। তারপর খাব। তুই খেয়ে নে।

সীমা এখন অনেক কিছু বোঝে। বাবার খাওয়া না হলে মা খাই না। কাল রাত থেকে না খেয়ে আছে। সামনে খাবার। তারপরও বাবার জন্য অপেক্ষা করছে। এটা নিয়ম। কিন্তু মা এই নিয়মকেই যেন ভালোবাসে।

সীমা খেয়ে ঘরে গেল। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। রিনা এসে বললো বাবা নামাজ পড়ে আসবে। তাহিরাও খাবার ঢেকে নামাজ পড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। ঘর অন্ধকার হলেও বাহির এখনও অন্ধকার হয়নি।চার্জার লাইট জ্বালিয়ে সীমা পড়তে বসেছে। পাশেই তাহিরা নামায পড়ছে।

আলতাফ মিয়ার বাড়ি ফিরতে ফিরতে বেশ রাত হয়ে গেল।ঘরে মেয়ের পড়ার শব্দ শুনা যাচ্ছে। তাহিরা তখনো জায়নামাজেই বসে ছিল। আলতাফ মিয়া এসে বারান্দায় বসেছে।রিনা মাকে বাবার আসার খবর দিল।তাহিরা এসে খাবার বাড়ছে।ভাতের সাথে আলু ও বেগুনের তরকারি।তাহিরা ভাতের প্লেট এগিয়ে দিল। আলতাফ মিয়া কিছু জিজ্ঞেস করে না। নিরবে খেতে বসে।গামলার ভাতের দিকে তাকাই। নিজের প্লেট থেকে কিছু ভাত গামলাই নামিয়ে রাখে। তাহিরা বাধা দেয়।

-কি হল, ভাত নামাচ্ছ কেন?
-তোমার ভাত কই?
-অনেকতো আছে?
-কই অনেক আছে?

তাহিরা আর কিছু বলে না। আলতাফ মিয়া ভাত খেতে থাকে। তাহিরা পাশে বসে আছে।কিছু জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু খাওয়ার মধ্যে জিজ্ঞেস করা ঠিক হবে না।আলতাফ মিয়ার খাওয়া শেষ হয়। তাহিরা জিজ্ঞেস করে।

-কাল কেউ কাজে ডাকেনি?
-রহমত হাজীর ছেলে বিদেশে লোক পাঠায়। সে বলছিল বিদেশে যায়তে।
-বিদেশ যাওয়ার টাকা পাবা কই?
-টাকা এখন লাগবে না। কি নিয়ম হইছে। ওখানে গিয়ে কাজ করে টাকা শোধ দেওয়া যাবে। বেতন ভালো।তিন-চার মাসেই নাকি টাকা শোধ হয়ে যাবে।
-এই তিন চার মাস আমরা কি খাব?
-বললাম না! বেতন ভালো। কিছু টাকা পাঠানোও যাবে।

তাহিরা খেতে বসে। খেতে খেতে স্বামীর বিদেশ যাওয়া নিয়ে ভাবে। স্বামী টাকা পাঠাচ্ছে। সে সেই টাকা দিয়ে বাজার করছে, চাল, ডাল, আলু, বেগুন, মাছ…।রান্না করছে। দুই মেয়েকে নিয়ে খেতে বসছে। হঠাৎ মনে হল কে যেন নাই! বুকটা কেন জানি তখন সব পেয়েও ফাকা ফাকা লাগছে।

আলতাফ মিয়া বিদেশ যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তাহিরা সব কিছু গুছিয়ে দিচ্ছে। রাত দশটায় গাড়ি। দুই মেয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব কিছু দেখছে। তাদের ভালো লাগছে। বাবা বিদেশে যাচ্ছে। অনেক টাকা পাঠাবে। পাশের বাড়ির এক চাচা বিদেশ থেকে অনেক টাকা পাঠায়। তাদের এখন পাকা বাড়ি।

-তাহিরা, পাঁচ কেজি চালতো কেনা হয়েছে। এই পাঁচশ টাকা রাখ। সপ্তা দুয়েক এতে চলে যাবে। এর মধ্যেই ইনশায়াল্লাহ টাকা পাঠাবো।পৌছানোর পরে হাজী সাহেবের বাড়িতে মোবাইল করব।
-না গেলে হত না? আমার কেন জানি ভয় লাগছে।
-ভয়ের কিছু নাই। আমি একা না। অনেকেই যাবে।
-সীমা, ভালো করে পড়া লেখা করবা, হ্যা।রিনা, তোমার জন্য কি আনবো?
-কিছু না?
-তোমার কিছুই লাগবে না?

রিনা চুপ করে থাকে। তার অনেক কিছুই লাগবে। কিন্তু কি লাগবে সে বুঝতে পারছে না।
আলতাফ মিয়ার যাওয়ার সময় হয়েছে। তাহিরা দরজায় দাঁড়িয়ে স্বামীর চলে যাওয়া দেখছে।আলতাফ মিয়ারও এখন মনে হচ্ছে ‘না গেলে হত না?’ মেয়ে দুটির দিকে সে তাকাই। তারাও তাকিয়ে থাকে। রিনা পিছন থেকে ডাকে।

-বাবা, আমার জন্য পুতুল আইনো।
-ঠিক আছে মা, তোমার জন্য অনেকগুলো পুতুল আনবো।

আলতাফ মিয়ার এখন সত্যিই যেতে ইচ্ছে করছে। মেয়ের জন্য পুতুল আনতে হবে। এখানে সে মেয়েকে পুতুল কিনে দিতে পারবে না।

গত একমাস ধরে তাহিরা হাজী সাহেবের বাড়িতে আসে স্বামীর ফোনের আসায়। আলতাফ মিয়ার ফোন আসেনা, টাকাও আসেনা। হাজী সাহেবের ছেলে বলে, ‘সময় হলেই ফোন করবে। তাড়াহুড়ো করলে হয়?’ তাড়াহুড়ো যে তাকে করতেই হয়। বাড়িতে যা সে দিয়ে গিয়েছিল তা শেষ হয়ে গেছে। এক সপ্তাহের মধ্যে ফোন করার কথা। কিন্তু মাস পেরিয়ে গেছে। তারপরও ফোন করছে না। একদিন গোরি চাচি ডেকে জিজ্ঞেস করলো-

-আলতাফ কোন দেশে গেছে রে?
-বলেছিলতো মালয়েশিয়ায়।
-টিভিতে দেখাচ্ছে, মালয়েশিয়ায় যেতে গিয়ে পানিতে ডুবে নাকি মানুষ মারা গেছে?
-মালয়শিয়ায় যেতে গেলে পানিতে ডুববে কেন? বিমান কি পানিতে চলে?

গোরি চাচিও বোঝে না। বিমান পানিতে চলে কিনা। তাহিরার খুব অস্থির লাগছে। কি করবে বুঝতে পারছে না। তার স্বামী সাতার জানে। পানিতে ডুববে না। সে বিশ্বাস করতে চাইছে না স্বামী পানিতে ডুবে মরেছে। কিন্তু যেখানে বিশ্বাসের বাতাস যত জো্রালো সেখানে অবিশ্বাসের ঢেউ তত প্রবল।

রাতে হাজী সাহেবের ছেলেকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে।গোরি চাচি তার ছেলেকে পুলিশের কাছে পাঠিয়েছিল আলতাফ মিয়ার খোজ নিতে। তাহিরা নিজেই যেতে চেয়েছিল। গোরিই নিষেধ করলো। ‘থানা ভালো জায়গা না’।থানা থেকে গোরি চাচির ছেলে খবর এনেছে, ‘যারা অবৈধ পথে বিদেশ গেছে সরকার তাদের দায় নিবে না’।বৈধ-অবৈধ তাহিরা বোঝেনা। খবরে দেখাচ্ছে অনেকেই বেচে ফিরছে। সেও আশাই আছে আলতাফ মিয়া একদিন ফিরে আসবে।

তাহিরার চারজনের সংসারে এখন তিনজন আছে।সে বুঝতে পেরেছে স্বামীর অপেক্ষায় থেকে কারোর পেটেই ভাত জুটবে না।সে গোরি চাচির বাড়িতে ঝিয়ের কাজ নিয়েছে। একবার খাওয়া, সাথে পাঁচশ টাকা মাইনা। গোরির কোন আত্বীয় শহরে থাকে। তাদের একটি কাজের মেয়ে খুব দরকার। তাই সীমাকে তারা চাইছে। সীমাও যেতে রাজি হয়েছে। এ পৃথিবীর অনেক নিয়ম এখন সে বুঝতে শিখেছে।তাহিরাও না করেনি। আজকে তাকে নিতে এসেছে।সীমা যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। মা আর রিনা বারান্দায় বসে আছে। কেউ তাকে গুছিয়ে দিচ্ছে না। সীমা ব্যগে তার পোষাক নিয়ে বাইরে বের হয়ে আসলো। গোরি দাদির আত্বীয় ভদ্রলোক বাইরেই দাঁড়িয়ে আছে। রিনা পিছন থেকে ডাকে।

-আপু, আমার জন্য পুতুল আইনো।

সীমা কোন কথা বলে না। তাহিরা ডুকরে কেদে উঠে। গিয়ে সীমাকে জোড়িয়ে ধরে। ‘আমি মেয়েকে দিব না। আপনারা অন্য কোন মেয়ে দেখে নেন’। দুজনে দুজনকে জড়িয়ে ধরে আছে। দুজনেই কাঁদছে। ভদ্রলোক তাদের কান্না থামার অপেক্ষা করছে। সে জানে কিছুক্ষণ পরেই তারা বাস্তব জীবনে ফিরে আসবে। সেখানে পেটের ক্ষুধা কান্না দিয়ে মিটে না।

Visits: 5

মন্তব্য
Loading...
//oudsutch.com/4/4139233