ইতি- আপনার একান্ত অনুগত…
শ্রদ্ধেয় আব্বু-আম্মু,
আসসালামু আ’লাইকুম। আপনারা সুস্থ-সবল আছেন এটাই আমার সন্তুষ্টি ও কামনা। ছোটবেলা থেকেই আপনারা শিখিয়েছেন এবং বিদ্যালয়েও শিখেছি- “পৃথিবীতে সবচেয়ে আপনজন মা-বাবা”। তাই সন্তানের অনুভূতি উপলব্ধি করবেন, সেটাই আশা রাখি। আপনাদের যে বিষয়গুলো অতিরিক্ত, অযৌক্তিক ও জুলুম বলে মনে হয় সেটা নিয়ে সবসময় সামনা সামনি বলার সুযোগ না হওয়ায় আজ কলমের আশ্রয় নিয়েছি।
বেশ কিছু দিন আগে, ভাই-আপনাদেরকে একটা মেয়ের বায়োডাটা দেখিয়েছে। কিন্তু আম্মু-আপনি সেই মেয়েটাকে পছন্দ করেন কি। কারণ কি ছিলো? বলেছেন- “দূর! মেয়ে তো বেঁটে, মাত্র ৫ ফিট! আর রঙ তো শ্যামলা। নাহ! আমার পছন্দ হয় নি”। অথচ ভাইয়ের গায়ের রঙও কিন্তু শ্যামলা। যাই হোক- আপনারা কেউই সেই মেয়ের সাথে একটু কথা বলে দেখলেনও না যে, তার ধ্যান-ধারণা, জ্ঞান, মানসিকতা, নৈতিকতা কেমন। সেই ভিত্তিতে ভাইয়ের সাথে ম্যাচ হবে কিনা। না, আপনারা তা দেখেন নি।
বলছেন- ৫ ফিটের কথা। অথচ আম্মু- আপনার মেয়েই তো ৫ ফিট! তাহলে আজ আপনি নিজের ঘরে না তাকিয়ে অন্য মেয়েকে সেই শব্দটি ছুঁড়ে দিলেন- যেটা আপনার মেয়েকে কেউ বলুক- তা আপনি নিজেই পছন্দ করেন না। আর আরেকটা বিষয়। ৫ ফিটকে কি বেঁটে বলা যায়? যেখানে বাংলাদেশের অধিকাংশ মেয়েরাই ৫-৫ফিট ৩ ইঞ্চের মধ্যে?
এবার আসি দ্বিতীয় প্রসঙ্গে। আম্মু- আপনি বলেছেন- ‘মেয়ে তো শ্যামলা’। আম্মু আপনি কি ভুলে গেছেন?- ছোটবেলায় আপনি আমাদের শিক্ষণীয় গল্প শোনাতেন। যেসব গল্পের মূল বার্তা থাকতো- মানুষ তার গুণের মাধ্যমেই, তার সৎ চরিত্রের মাধ্যমেই সমাজে প্রতিষ্ঠিত ও পরকালে মুক্তি পেতে পারে। অথচ আজ আপনি একটা মানুষকে শুধু উপরি রঙ দেখে বিচার করছেন? আচ্ছা, আম্মু- আপনি কি ফর্সা? আমরা কি ফর্সা? তো, আপনি একটা মেয়েকে শুধু ফর্সা না হওয়ার কারণে বাদ দিচ্ছেন, তাহলে তো কাল হয়ত কেউ আমাকে শুধুমাত্র ফর্সা না হওয়ার জন্যই বাদ দিবে…তখন কি আপনার ভালো লাগবে? নিশ্চয়ই না।
কি অবাক বিষয়, তাই না আম্মু! বলা হয়- নারী নাকি নারীর দুঃখ বুঝে, আসলেই কি তাই? আজকাল ‘ফর্সা চাই’, ‘ফর্সা চাই’- করতে করতে নারীদের পুঁজিবাদের বেড়াজালে আটকানো হচ্ছে। অতিরিক্ত প্রসাধনীর ব্যবহার, রঙ ফর্সা করা ক্ষতিকারক সীসাযুক্ত ক্রিমের ব্যবহার, অতিরিক্ত পার্লারে যাওয়া। এটার পিছনেই সময়, টাকা ও শ্রম ব্যয় করা। কতো যে ঘষা-মাজা চলছে- সেটা আর আলাদা করে নাই বা বললাম। আফসোস লাগে, এইরূপ ঘষা-মাজা যদি মনটাকে সুন্দর করার জন্য করা হতো! আর আম্মু, অপরূপ সুন্দরী দেখে বৌ এনে কি হচ্ছে? দেখা যাচ্ছে- যে বৌকে নিয়ে আপনি সবার সামনে তার রূপের বর্ণনা করে ‘আমার বৌ’ বলে গর্ব করতেন, সেই কিনা পরিবারের বড়দের অসম্মান করছে। তাহলে আম্মু, অবশেষে হলোটা কি?
আব্বু- আপনাকেও একটু বলতে চাই…ছোট মুখ বড় কথা তাও বলি- জামাই পছন্দ করতে গিয়ে আপনি এমন সব শর্ত জুড়ে বসে আছেন, যেগুলো আপনার মধ্যেও নেই। এমন কি আপনি যখন আম্মুকে বিয়ে করেছিলেন- তখনও ছিলো না। আপনি চান- ছেলের নিজস্ব বাড়ি কিংবা আলাদা ফ্ল্যাট বা বাবার সম্পত্তি থেকে ভাগ করা আলাদা জমি। বাড়ির সাথে গাড়ি থাকলে তো আরো ভালো। উপার্জনও সেইরকম। ধনী পরিবারের ধনাঢ্য ছেলে! সেই সাথে ছেলের বয়সও যাতে বেশি না হয় এবং দেখতে হিরোর মতো!
আব্বু, সমাজের মানুষ কি কান্ডজ্ঞানহীন হয়ে পড়েছে? একটা মানুষের বয়স কতো হলে টাকা জমিয়ে নিজের একটা স্থায়ী ঠিকানা, আলাদা ফ্ল্যাট করতে পারে? আমি তো জানি- পৃথিবীতে হালাল উপার্জন করা অনেক কষ্টসাধ্য ব্যাপার। আর তাই তো একটা স্থায়ী ঠিকানা করতে আপনাকেও যুবক থেকে পৌঢ় বয়সে উপনিত হতে হলো। তাহলে আব্বু- আপনি কি ৪৫/৫০ বছরের বয়ষ্ক ছেলের কাছে মেয়েকে বিয়ে দিতে চান? না, আপনি সেটা চাইবেন না। তাহলে আপনি কম বয়স চাচ্ছেন, আবার বাড়ি-গাড়ি- উচ্চ বেতনও চাচ্ছেন- এটা কি অযৌক্তিক নয়? এমন কি আপনি যখন আম্মুকে বিয়ে করেছিলেন, তখন তো একটা মুদি দোকান আর সামান্য চাকরি ছাড়া আর কিছুই আপনার ছিলো না। যা হলো সব বিয়ের পরে। তাহলে?
আব্বু, আপনি মেয়েকে যেখানে ‘স্বামীর উপার্জনে সুখী থেকো” –এমন বলে নসিহত করবেন, সেখানে আপনি সুখের সংজ্ঞা ধরে নিয়েছেন অঢেল টাকা- যার কোনা সীমা নেই। আদৌ কী ছেলের অঢেল টাকা থাকলে আপনার মেয়ে সুখী হবে? যদি ছেলেটার মানসিকতাই ভালো না হয়? ধর্মীয় জ্ঞান তথা নৈতিকতাই না থাকে?
তাছাড়া আপনি চাইছেন- দেখতে হ্যান্ডসাম হিরো, মডেলের মতো ছেলে। আব্বু, সেরকম ছেলের পিছনে যে কতো মেয়ে ঘুরে আর কতককে সে ঘুরায়- সেটার হিসাব না হয় নাই বা দিলাম…আপনি হয়তো ভালোই অবগত আছেন। কারণ আপনি অভিজ্ঞ। তবে জানেন আব্বু- আজকাল ছেলেদের এরূপ উপরি হাব-ভাব দেখে বিবেচনা করা হচ্ছে বলেই নিত্যনতুন men’s ফেয়ারনেস ক্রিম, ফেসওয়াশ বের হচ্ছে। আর এসব ব্যবহারকারী পুরুষদেরকেই বিজ্ঞাপনে active বলে প্রচার করা হচ্ছে, অথচ activeness তো উপরের রূপ থেকে নয়, বরং শারীরিক শক্তি ও মনের বল থেকে আসে। এদিকে সাজসজ্জার ক্ষেত্রে যেখানে নারীদেরকেই বুঝানো হতো, আজকাল এটা পুরুষের ক্ষেত্রেও ব্যবহৃত হচ্ছে, দিন দিন মেনস বিউটি পার্লারের সংখ্যাও বাড়ছে। শুধু তাই নয়- American Society for Aesthetic Plastic Surgery (2014)’র এক জরিপে প্রকাশ শুধু ২০১৩ সালেই, বিশ্বে প্রায় ১০ লাখের মতো পুরুষ নিজেদের দৈহিক সৌন্দর্য বাড়াতে প্রসাধনী সামগ্রীর পিছনে ছুটেছে। আর ১৯৯৭ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত ছেলেদের মধ্যে সার্জারী করে দৈহিক সৌন্দর্য বাড়ানোর প্রবণতা বেড়েছে ৫০%। সুতরাং, যুবসমাজকে এ পথে ঠেকে দেয়ার জন্য দায়ী তাহলে কারা?
সবশেষে-জানি না, আমার এতো বড় চিঠি পড়ার ধৈর্য আপনাদের হচ্ছে কিনা। বেয়াদবী হলে ক্ষমা চাচ্ছি। তবে আমি মনে করি- এরূপ মানসিকতা সুষ্ঠ সমাজ গঠনের পথে বাঁধা। তাছাড়া এটা কি সত্য নয়, যে- যেখানে জ্ঞানের কদর হয় না, সেখানে জ্ঞানী (হোক সে ছেলে/মেয়ে) জন্মায় না? তাই আরো কতো দশক পরে আমাদের সমাজে জ্ঞানের কদর হবে, সমাজ সুষ্ঠভাবে পরিবর্তিত হবে জানি না। তবে আল্লাহ’র কাছে দুয়া করি- যাতে পরবর্তীতে আমি আমার সন্তানের জীবনসঙ্গী বাছাই করতে এরূপ না করি…
ইতি
আপনার একান্ত অনুগত
আদরের মেয়ে –
Visits: 1