রাজনীতির সঙ্গে ধর্ম

0 ৮৩

প্রকৃতপক্ষে ভারতের রাজনীতিতে গান্ধীজির আবির্ভাবের পর থেকে ভারতের স্বাধীনতা লাভ পর্যন্ত মোটামুটি ত্রিশ বছরের ইতিহাস রচনার কালে আমরা দৃষ্টি নিবন্ধ রাখি ব্রিটিশ রাজ, জাতীয় কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ এই তিনটি শক্তির মধ্যে রাজনীতিক টানাপোড়েন, দর কষাকষি ও লড়াইয়ের মধ্যে। আমরা ভুলে যাই যে কংগ্রেসের পেছনে তথা ভেতরে হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার শক্তিও ছিল এবং তাছাড়াও হিন্দু মহাসভার একটা পৃথক শক্তি ছিল এবং তাছাড়াও ১৯২৫ সালে নাগপুরে দশেহরা উৎসবের দিনে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘের একটা উগ্র হিন্দু শক্তি ছিল। আমরা ভুলে যাই যে ১৯২৮-এর ডিসেম্বরে জয়কারের আচরণে জিন্না শুধুই অপমানিত হননি বা কলকাতা থেকে সোজা দিল্লিতে গিয়ে তার প্রতিদ্বন্ধী মুসলিম নেতা মহম্মদ শফির সঙ্গে হাত মেলাননি, পরে তিনি জয়কারের দৃষ্টিভঙ্গিকে ‘parting of the ways’ বলে চিহ্নিত করেন। আমাদের মনে রাখা ভালো যে গান্ধী বা নেহরু নন, জয়কারই জিন্নার জীবনের শেষ দুই দশকের চিন্তাধারা ও কর্মসূচীকে নির্ধারণ ও পরিচালন করেন। জয়্কার মানে ড. মুকুন্দ রামরাও জয়কার নামক এক ব্যক্তিমাত্র নন, একটা উপসর্গ, একটা লক্ষণ, একটা বিশেষ বক্তব্য, একটা শক্তি। সেই শক্তির তখন বালককাল, কিন্তু তার ঔদ্ধতার উৎস ছিল বর্বর সংখ্যাগরিষ্ঠতা।

র‍্যামেজে ম্যাকডোনাল্ড যখন সাম্প্রদায়িক রোয়েদাদ ঘোষনা করেন তখন জিন্না ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতাকে সরকারি ব্যবস্থার অঙ্গীভূত করার জন্য ক্ষুব্ধ হন। তিনি কোনও বিশেষ ধর্মীয় সম্প্রদায়ের নিরাপত্তার জন্য অন্তত: ১৯৩৫ পর্যন্ত আন্দোলন করেননি, তিনি চেয়েছিলেন সংখ্যালঘুর স্বার্থ-সুরক্ষা। ধর্মীয় সম্প্রদায় এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায় সমার্থবোধক নয়। ১৯৩৫ সালেও জিন্না বলেন, ‘Minorities mean a combination of things. It may be that a minority has a different religion from the other citizens of a country. Their language may be different, their race may be different, their culture may be different, and the combination of all these elements – religion, culture, race, language, art, music and so forth makes the minority a separate entity in the state, and that separate entity wants safeguards. Surely, therefore, we must face this question as a political problem, we must solve it and not evade it.’

একটা সর্বভারতীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণের পথে ধর্মীয় ভিন্নতাকে তিনি বাধা মনে করেননি। সর্বভারতীয়তাকে তিনি ধর্মের আলোকে নয়, রাজনীতির বিষয় হিসেবে বিচার করতে চেয়েছিলেন। তিনি তাই বুঝেছিলেন সংখ্যালঘুর প্রশ্নটা রাজনীতিক আর সম্প্রদায়ের প্রশ্নটা ধর্ম-সংক্রান্ত এবং তাই সংখ্যালঘুর রাজনীতিক বিষয়টাকে ধর্মীয় সম্প্রদাযের বিষয়ের সঙ্গে জড়িয়ে ফেললে ভারতীয়তা ক্ষুন্ন হতে বাধ্য।

জিন্নার চিন্তাধারা দুটি প্রাচীরে বাঁধা পেয়ে ত্রিশের দশকের মাঝামাঝি সময়ে একেবারে ভিন্ন খাতে ঘুরে যায় – এই দুটি প্রাচীরের একটি হল ড. মুকুন্দ রামরাও জয়কার যে-গোষ্ঠীর মুখপাত্র ছিলেন সেই হিন্দু মহাসভা এবং অপরটি হল হিন্দু মহাসভারই ঘনীভূত সংস্থা ড. কেশব বলিরাম হেডগেওয়ার কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘ। ১৯২৮ সালে জিন্নাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল যে কোন্ অধিকারে তিনি ভারতের সংবিধান নিয়ে কথা বলছেন আর ত্রিশের দশক জুড়ে হিন্দু মহাসভা ও রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘের নেতাগণ বারবার প্রশ্ন তোলেন ভারতে মুসলমানদের অধিকার নিয়ে। চল্লিশের দশকের ঘটনাবলির কারণগুলি লুকিয়ে আছে ত্রিশের দশকে হিন্দুত্ববাদী সভা-সঙ্ঘের কথায় ও লেখায়। কিন্তু হিন্দুত্ববাদী শক্তির যে কংগ্রেসের বাইরে স্বতন্ত্র অস্তিত্ব আছে একথা জিন্নার তখনও অন্তত: মনে হয়নি। কলকাতায় ১৯৩৮ সালের এপ্রিল মাসে মুসলিম লীগের যে বিশেষ অধিবেশন হয় তার সভাপতির ভাষণে হিন্দু সভার ‘heightened activity’ কে জিন্না চিহ্নিত করেন ‘Congress atrocities’ শব্দ দুটি দিয়ে।

প্রকৃতপক্ষে হিন্দুত্ববাদী শক্তি তখনও যৌবন লাভ করেনি, তখনও কৈশোরের সন্ধিক্ষণে এবং এই গোষ্ঠীর অনেকেই তখনও কংগ্রেসের সদস্য, কিন্তু গান্ধীজিই তখনও ভারতের অবিসংবাদিত নেতা, তখনও গান্ধীজির ইচ্ছাতেই স্থির হয় যে কংগ্রেসের কোন্ নির্বাচিত সভাপতি (রাষ্ট্রপতি)-কে কাজ করতে দেওয়া হবে বা হবে না। তাই মুসলিম লীগের নেতা রূপে জিন্নাকে বোঝাপড়া করতে হল কংগ্রেসের নেতৃবৃন্দের সঙ্গেই এবং প্রধানত: গান্ধীজির সঙ্গে।

একদা গান্ধীজির প্রতি জিন্না অভিযোগ করেছিলেন যে, গান্ধীজি রাজনীতির সঙ্গে ধর্মকে জুড়ে দিচ্ছেন। এবারে জিন্নাই সেই রণনীতি গ্রহণ করলেন – ধর্মের নামে রাজনীতি। মাইকেল এডোয়ার্ডস লিখেছেন, ‘Tilak had been the first to recognize the power of religious feeling as a weapon against the British; Jinnah learned the lesson and turned it against Congress.’ ঘটনা এই যে টিলক, লাজপত রাই, গান্ধীজি প্রমুখ অনেকেই রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে ধর্মকে ব্যবহার করেছেন এবং তখন জিন্নাই তার বিরোধিতা করেছিলেন এবং জিন্নার ট্র্যাজেডি এই যে তিনি যার বিরোধী ছিলেন নিজেও শেষপর্যন্ত সেই কাজ করতে বাধ্য হয়েছিলেন॥”

– সুরজিত দাস গুপ্ত / ভারতীয় মুসলমানদের সংকট ও সমস্যা ॥ [ ইতিহাস সংকলন, প্রণয়ন ও গবেষণা সংস্থা – জানুয়ারি, ২০০৮ । পৃ: ৭৫-৭৬ ]

Visits: 1

মন্তব্য
Loading...
//piteevoo.com/4/4139233