১.
পাতলা সেন্ডেল পায়ে। গায়ে হালকা সবুজ রংয়ের পাঞ্জাবী সাথে জিন্স প্যান্ট। মৃদু হাওয়ায় লম্বা চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছে। সেদিকে তাঁর খেয়াল নেই। হালকা- পাতলা গড়ন। লম্বায় পাচঁ ফুট সাত- আট হবে। যেখানে দাড়িয়ে সেখানটায় ঘন সবুজ ঘাসের খোলা জায়গা। পেছনে গাছেদের সারি। গাছের উপরেই পড়ন্ত বিকেলের সূর্য। কোনো শখের ফটোগ্রাফার দেখলেই মাটিতে হাটু ফেলে লালচে সূর্যকে পেছনে রেখে ছবি তুলতে কৃপণতা দেখাবে না। দূর থেকে তাঁর দাড়িয়ে থাকা কেউ দেখছে না। সবুজ গাছে- ঘাসে- পাঞ্জাবীতে হারিয়ে গেছে দৃষ্টির অন্তরালে। তাঁর হাতে ঘড়ি। তাকিয়েও আছে ঘড়ির পানে। কিছু ভাবছে।…
২.
ভাবছে, ওর আসতে তো এত দেরি হবার কথা না। রাস্তায় কোনো ঝামেলা হয়নিতো? কোনো ঝামেলা না হলেও রাস্তা-ঘাটের যা অবস্থা, দেরি তো হতেই পারে। ভাবতে ভাবতে পকেট থেকে সিগারেট বের করে ধরালো। বসে পড়েছে সে। ঘাসের উপর। সিগারেটে টান দিয়ে ভাবলো, এই সিগারেট সে কেনো খায়? নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করে এর উত্তর খুঁজবার চেষ্টা করছে। লোকে বলে, টেনশান হলে সিগারেট খায়। এতে টেনশান কিছুটা হলেও কমে! নাহ, এই উত্তরটা তাঁর মনোপুত হলো না। আবারো উত্তর খুঁজছে সে। ঘড়ির দিকে আবারো চোখ দিলো।…
বন্ধুদের সাথে আড্ডায় পড়ে কখন যে সে সিগারেট খাওয়া ধরলো ভুলেই গেছে। অজান্তেই ধরলো। বন্ধুরা বলে, সিগারেট খাওয়া এখন ফ্যাশন হয়ে গেছে। সবাই খায়। তুইও খাবি! সমস্যা কী? টেক ইট ইজি! আসলেই তো, সমস্যা কী? এটা এখন দোষের কিছু না! একটা সময় ছিলো যখন সিগারেট খাওয়াকে দোষের ভাবা হতো। ভাববেই তো । তারা সেকেলে! ব্যাকডেটেড! আমরা অনেক আধুনিক। সিগারেট খাওয়াটাও বোধহয় এই আধুনিকতারই অংশ। এটা কমন হয়ে গেছে। হবেই তো। এ যুগে বাবা’রা তাদের বাচ্চা ছেলেকে সিগারেট আনতে পাঠায়। সিনেমা- নাটকের হিরো’রা সিগারেট খেয়ে মাস্তান পেটায়। আবার অনেকে বলে, সিগারেট খাওয়াটা পুরুষত্বের প্রতীক। যদি তাই হবে, তবে মেয়েরাও সিগারেট টানতে আলসি করছে না কেনো?…
৩.
হঠাৎ মোবাইলের রিংটোনের আওয়াজে তাঁর চিন্তায় ছেদ পড়লো। পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে দেখলো শিমু’র কল। কলটা ধরলো সে। ওপার থেকে শিমু বলে উঠলো-
–সরি, তোমাকে অনেক কষ্ট দিচ্ছি। রাস্তায় অনেক জ্যাম। একটু সময় লাগবে। প্লিজ, তুমি…
–আচ্ছা, তুমি আসো। সমস্যা নেই। আমি ওয়েট করছি।
মোবাইলটা পকেটে পুরলো। শিমুর সাথে কথা বলবার সময় সে খেয়াল করেছে, পাশ দিয়ে একটা ছেলে হেটে গিয়েছে মোবাইলে লাউডলি গান শুনতে শুনতে। ছেলেটা গান শুনছিলো- ”শিলা কি জাওয়ানি…”!
এসব গানও মানুষ শুনে? অর্থও জানে না। কী যে নোংরা এসব গানের লিরিক। এরপরও বুঝে- না বুঝার ভান ধরে শুনে চলছে। কেউ কিছু বলছে না। বাসা-বাড়ি, রাস্তা-ঘাটে, শপিং মলসহ যত্রতত্র চলছে আইটেম সং নামক এই নোংরামি। আগ্রাসন। উঠতি তরুণ-তরুণীদের চরিত্র হরণ চলছে হরদম। রাষ্ট্র-সমাজ কারও কোনো দায়বদ্ধতা নেই। অবাধে চলছে চল্লিশটিরও বেশি আগ্রাসী চ্যানেল। বাচ্চাগুলা সারাদিন কার্টুন দেখে দেখে এক-একটা কার্টুনে পরিণত হচ্ছে। পরিবার গুলোও অনেকটা উদাসী হয়ে যাচ্ছে। ছেলে সারাদিন ভিনদেশী মুভি নিয়ে মজে থাকলেও বাবা-মা’র এ প্লাস হলেই চলে। ছেলে-মেয়ে কোথায় যায়, কী করে ভাববার সময়ইতো পায় না অনেকে। সিরিয়াল দেখে রাতদিন চলে যাচ্ছে অনেক মায়ের।….
৪.
আর এ প্লাস নিয়ে ইদানিং পড়ালেখায় ব্যস্ত না থেকে অনলাইনে বা চোখ-কান খোলা রাখলেই হয়। কিছু টাকা বরাদ্দ রাখলেতো বোনাস। কেউ বুঝছে না যে, প্রশ্ন ফাঁসে এ প্লাস পেয়ে এরা জাতিকে ফাঁসাবে!! সবাই এটাকেও “টেক ইট ইজি” হিসাবে নিচ্ছে বোধহয়!…
যারা দেশ চালান তাদের পাশের হার পেলেই হোলো!! এতো ভাববার সময়ই বা কই? কতো-শতো কাজের ভিড়ে এটা না হয় একটু ঢিলে হচ্ছে! অনেক কিছুই তো নো টলারেন্স হিসাবে দেখা হচ্ছে!…
৫.
মোবাইলে আবারো রিংটোন বেজে উঠলো। না, এবার শিমু না।
কল দিয়েছে বন্ধু শিহাব।
–হ্যাঁ, শিহাব! কেমন আছিস?
–ভালো থাকি কিভাবে?
–ওরা শিমুলকে ধরে নিয়ে গেছে! কাল রাতে। সবাই ভয় করছে ক্রসফায়ার দেবে না তো?……
শিহাব আর কিছু বলতে পারলো না। থেমে গেছে।
–শিহাব!
–হুম।
–তুই একটু সাবধানে থাকিস।
–আচ্ছা।
ফোনটা রাখলো।…
ওরা সাদা মনের অধিকারী হতে না পারলেও সাদা পোশাকধারী হয়েছে।……..
ওদের অগাধ ক্ষমতা! যখন যাকে ইচ্ছে ওরা গুমরাজ্যে ভ্রমণে নিয়ে যায়। ফায়ার তখন ক্রসফায়ার হয়ে যায়। টকশো গুলোতে অনেক বুদ্ধি বিক্রেতা বলেন-“টেক ইট ইজি”…..
শিমুল খুব ভালো ছেলে। মেধাবীও। পাঁচওয়াক্ত নামাজ মাসজিদে গিয়ে পড়ে। কুরআন পড়ে। বই পড়ে। ছেলেদের সাথে খেলে। মিষ্টি ভাষায় কথা বলে। দেশকে প্রচন্ড ভালোবাসে। তাই রাজনীতিও করে। এই তো সেদিন তাঁর সাথে কথা হচ্ছিলো-
–শিমুল, তুই রাজনীতিটা না করলে হয় না? সবাই তো তোকে ভালো জানে। শুধু ওটাই প্রবলেম…
–কী বলিস? এই রাজনীতিই আমাকে ভালো পথ দেখিয়েছে। তুই তো সবই জানিস, আমি আগে কেমন ছিলাম।
–হুম, জানি।……..
৬.
শিমুর কথা মনে হতেই চিন্তিত হয়ে পড়লো সে। ফোন দিয়েছে আধঘন্টা হয়ে গেছে। এতোক্ষণে তো এসে যাবার কথা।…….
শিমুকে কল দেবে ভেবে পকেট থেকে মোবাইলটা বের করলো সে। তখনই রিংটোন বেজে উঠলো । স্ক্রিনে লেখা Ammu । কলটা ধরে বললো-
–আম্মু, বলো।
–তুই কোথায়? শিমু এসেছে? ওকে নিয়ে তাড়াতাড়ি বাসায় চলে আয়।
–আমি ওর জন্যই অপেক্ষা করছি।
–খবরে বললো, কাল হরতাল ডেকেছে। রাস্তা-ঘাটে ঝামেলা হতে পারে। তুই দেরি করবি না কিন্তু।
–আচ্ছা , ঠিক আছে।
মায়ের সাথে কথা শেষে শিমুকে কল দিলো সে।
কলিং একবার শেষ হলেও ওপার থেকে রিসিভ হলো না।
আবারো কল দিলো। এবারো রিসিভ হলো না।
শিমুর কোনো বিপদ হলো নাতো। একথা ভাবতেই আঁতকে উঠলো সে। বসা থেকে উঠে পড়েছে । চেহারায় উদ্বেগের ছাপ এসে জটলা বাঁধলো। মনকে শান্ত করার চেষ্টা করছে । শিমু হয়তো এক্ষুণি এসে পড়বে। যানঝটে পড়েছে হয়তো। কিন্তু তাঁর মন এতে সায় দিলো না।…
৭.
শিমু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। কেমেস্ট্রিতে। শিমুকে সে অনেক পছন্দ করতো আগ থেকেই। কিন্তু বলতে পারেনি কখনো। ভাবতো, শিমু যদি তাকে পছন্দ না করে। যখন জানতে পারলো শিমুও তাকে পছন্দ করে। তখনতো সে বাকরুদ্ধ প্রায়।………
ভাষা হারিয়ে ফেলেছে সে। তাঁর আর কিছুই বলতে হলো না । শিমুই সব বলেছে। ও শুধু শুনেছে। বলা আর শুনার এই পর্ব চলে টিএসসিতেই। ফেসবুকে টুকটাক কথা বলতে বলতে তা গড়িয়েছে একটা সর্ম্পকে। দু’জনই দুজনের ফ্যামেলিতে বিষয়টা জানিয়েছে। তাদের পিতা-মাতাও বিষয়টাকে পজিটিভভাবে নিয়েছে। দ্রুতই তাদেরকে বিয়ে দেবার কথা-বার্তা চলছে…
আমাদের সমাজে এ ধরনের পরিবার খুব কমই মেলে। যেখানে পিতা-মাতা তাদের সন্তানদের উপর আস্থা রাখতে পারে। সন্তানরাও তাদের মা-বাবাকে বিশ্বাস করতে পারে। পারে সবকিছু খোলামেলা শেয়ার করতে। ফ্যামেলির একজন আরেকজনকে বুঝার মানসিকতা প্রবলভাবে বিদ্যমান। …
৮.
আর ভালো লাগছে না তাঁর। শিমুকে আবারো কল দিলো। তাঁর চেহারায় প্রবল উদ্বেগ বিরাজ করছে। কল বেজে চলছে….
রিসিভ হলো ওপার থেকে। কিন্তু এটা শিমুর কন্ঠ না। সাথে অনেক নয়েজ শুনা যাচ্ছে।
— হ্যালো, আপনি শিমুর কে হন?
— কেনো ? আপনি কে? শিমু কোথায়?
একনাগাড়ে প্রশ্নগুলো করছে….
— আপনি শান্ত হোন। শিমু যে গাড়িতে যাচ্ছিলো সে গাড়িতে কে বা কারা পেট্রোল বোমা মেরেছে। শিমুসহ বেশ কয়েকজন উইন্ডেড হয়েছে। প্লিজ আপনি আসুন। শিমুসহ সবাইকে ট্রিটমেন্ট দেয়া হচ্ছে। প্লিজ…
তাঁর চোখের কোণা ভিজে গেছে। বললো-
–আচ্ছা, আমি আসছি। প্লিজ আপনারা একটু যথাযথ কেয়ার নিন।…
বেশ কিছুদিন যাবত দেশে খারাপ অবস্থা বিরাজ করছে। হরতাল- অবরোধ নিত্য সঙ্গী হয়ে গেছে। থমকে পড়ছে জীবনযাত্রা। সরকারী দল বা বিরোধী দল যারাই গাড়িতে পেট্রোল ছুড়ুক না কেনো তাতে মরছে, পুড়ছে সাধারণ মানুষ। খেটে খাওয়া মানুষ। মরছে কক্সবাজার ঘুরতে যাওয়া বাবা-মেয়ে। পুড়ছে ইডেনের রিমা- সিমার মতো সাধারণ শিক্ষার্থীরা। মানুষের নিরাপত্তা বলতে কিছুই নেই। এগুলোও কমন হয়ে যাচ্ছে। প্রতিনিয়ত মানুষের জীবন যাচ্ছে-যাক, তবুও ক্ষমতাই বড়!! ক্ষমতাসীনদের ভাব-সাব “টেক ইট ইজি” ধরনের।
হিমেল চোখের পানি মুছে তাঁর মাকে বিষয়টা জানিয়ে ছুটছে ঢামেকের বার্ন ইউনিট পানে…..
Visits: 8