রাজধানী ঢাকার অলিগলির নাম

0 ৭৫

ঢাকার ঐতিহ্য হাজার বছরের পুরনো। এটা শুধু বাংলাদেশের রাজধানীই নয়: সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এটি দেশের প্রাণকেন্দ্রও বটে। এ শহর সুলতানি, মুঘল, নবাবি এবং ব্রিটিশ আমলের স্মৃতিতে ঋদ্ধ হয়েছে এ ঢাকার ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি।
প্রাচীন এই শহরে রয়েছে হরেক রকমের রাস্ত-ঘাট, অলি-গলি, পাড়া-মহল্লা বা এলাকা। এগুলোর আবার রয়েছে অনেক মজার এবং অদ্ভূত নাম। যেমন: তোপখানা, টিকাটুলি, ফার্মগেট, শ্যামলী, মালিবাগ, কাকরাইল, কাগজীটোলা, এলিফেন্ট রোড়, নয়া পল্টন ও পুরানা পল্টন, স্বামীবাগ, গোপীবাগ প্রভৃতি।

এসব অদ্ভূত নামের অর্থই বা কী! এককালে কাকরাইলের পুকুর, খাল, রাস্তা-ঘাট এমনকি মানুষের শয়নকক্ষেও কী কাঁকড়ার বিচরণ ছিল? নাকি সেখানকার মানুষেরা কাঁকড়াভোজী ছিলেন? ধানমণ্ডিতে নিশ্চয়ই এককালে প্রচুর ধানক্ষেত ছিল। আর এলিফেন্ট রোড ছিল হাতিদের অভয়ারণ্য।

এসব নাম আজ আমাদের কাছে অনেক মজার মনে হলেও তা আসলে ঢাকার সুপ্রাচীন ইতিহাস ও ঐতিহ্যকেই বহন করে। ঐতিহ্যবাহী ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকার নামকরণের ইতিহাস তুলে ধরা হলো_____________________________

কাকরাইল
ঊনিশ শতকের শেষ দশকে ঢাকার কমিশনার ছিলেন মি. ককরেল। সম্ভবত তার নামে এই এলাকায় কোনো রাস্তা ছিল। সে সময় ইংরেজ কমিশনারদের নামে রাস্তার নামকরণ করার রেওয়াজ ছিল। সেই ককরেল রোড থেকে কালক্রমে এলাকার নাম হয়ে যায় কাকরাইল।

পিলখানা
ইংরেজ শাসনামলে যাতায়াত, মালামাল পরিবহন ও যুদ্ধের কাজে প্রচুর হাতি ব্যবহার করা হতো। বন্যহাতিকে পোষ মানানো হতো যেসব জায়গায় সেগুলোকে বলা হতো পিলখানা। সে সময় ঢাকায় একটি বড় সরকারি পিলখানা ছিল। সরকারি কাজের বাইরেও ধনাঢ্য ঢাকাবাসীরা নির্দিষ্ট পরিমাণ ফি দিয়ে তাদের হাতিগুলোকে এখানে পোষ মানানোর জন্য পাঠাতেন।

এলিফ্যান্ট রোড
সে সময়ে রমনা এলাকায় মানুষ-জন তেমন বাস করত না। ছিল বিস্তীর্ণ ফাঁকা এলাকা। এখানে পিলখানার হাতিগুলোকে চরানো হতো আর আশেপাশের খালে গোসল করানো হতো। যে রাস্তা দিয়ে পিলখানার হাতিগুলোকে রমনার মাঠে আনা-নেয়া করা হতো সে রাস্তাটাই আজকের এলিফ্যান্ট রোড।

ফার্মগেট
কৃষি উন্নয়ন, কৃষি ও পশুপালন গবেষণার জন্য ব্রিটিশ সরকার এখানে একটি ফার্ম বা খামার তৈরি করেছিল। সেই ফার্মের প্রধান ফটক বা গেট থেকে এলাকার নাম ফার্মগেট।

ইন্দিরা রোড
বেশিরভাগ মানুষের ধারণা ভারতের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নামে নামকরণ করা হয়েছে রাস্তাটির। আসলে তা নয়। এককালে এ এলাকায় দ্বিজদাস বাবু নামে এক বিত্তশালী ব্যক্তি বাস করতেন। তার ছিল বিশাল বাড়ি। বাড়ির কাছের এই রাস্তাটি তার বড় মেয়ে ইন্দিরার নামে নামকরণ করা হয় ইন্দিরা রোড।

টিকাটুলি
এক সময় হুক্কা টানার বেশ চল ছিল বাংলা মুলুকে। আর ঢাকার এই এলাকা ছিল হুক্কার ‘টিকা’ তৈরির জন্য বিখ্যাত। ‘টিকা’ তৈরিকারকরা এই এলাকায় বাস করতেন ও ব্যবসা করতেন।

ধানমণ্ডি
এখানে এককালে বড় একটি হাট বসত। হাটটি ধান ও অন্যান্য শস্য বিক্রির জন্য বিখ্যাত ছিল।

শ্যামলী
১৯৫৭ সালে সমাজকর্মী আব্দুল গণি হায়দারসহ বেশ কয়েক ব্যক্তি এ এলাকায় বাড়ি করেন। এখানে যেহেতু প্রচুর গাছপালা ছিল তাই সবাই মিলে আলোচনা করে এলাকার নাম দেন শ্যামলী।

কাগজীটোলা
ইংরেজ শাসনামলে ঢাকায় কাগজ তৈরি করা হতো। যারা কাগজ তৈরি করতেন তাদের বলা হতো ‘কাগজী’। কাগজীরা যে এলাকায় বাস করতেন আর যেখানে কাগজ উৎপাদন ও বিক্রি করতেন সে এলাকাই কাগজীটোলা নামে পরিচিতি লাভ করে।

গোপীবাগ
গোপীনাগ নামক এক ধনী ব্যবসায়ী এই এলাকার মালিক ছিলেন। তিনি স্থাপন করেছিলেন ‘গোপীনাথ জিউর মন্দির’। তখন থেকেই এই এলাকার নাম গোপীবাগ।

চাঁদনী ঘাট
সুবাদার ইসলাম খাঁর একটা বিলাসবহুল প্রমোদতরী ছিল। প্রমোদতরীর নাম ছিল চাঁদনী। ‘চাঁদনী’ ঘাটে বাঁধা থাকত। অন্য কোনো নৌকা এই ঘাটে ভিড়তে পারত না। সেখান থেকে এলাকার নাম চাঁদনী ঘাট।

পাগলাপুল
সতেরো শতকে এখানে একটি নদী ছিল, নাম– পাগলা। মীর জুমলা নদীর উপর সুন্দর একটি পুল তৈরি করেছিলেন। অনেকেই সেই দৃষ্টিনন্দন পুল দেখতে আসত। সেখান থেকেই জায়গার নাম পাগলাপুল।

তোপখানা
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির গোলন্দাজ বাহিনীর অবস্থান ছিল এখানে।

পুরানা পল্টন, নয়া পল্টন
এই এলাকা ছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ঢাকাস্থ সেনানিবাস।

মালিবাগ
ঢাকা একসময় ছিল বাগানের শহর। বাগানের মালিকদের ছিল দারুণ কদর। বাড়িতে বাড়িতে তো বাগান ছিলই, বিত্তশালীরা এমনিতেও সৌখিন। তারা বিশাল বিশাল সব ফুলের বাগান করতেন। ঢাকার বিভিন্ন জায়গার নামের শেষে ‘বাগ’ শব্দ সেই চিহ্ন বহন করে। সে সময় মালিরা তাদের পরিবার নিয়ে যে এলাকায় বাস করতেন সেটাই আজকের মালিবাগ।

পরীবাগ
পরীবানু নামে নবাব আহসানউল্লাহর এক মেয়ে ছিল। সম্ভবত পরীবানুর নামে এখানে একটি বড় বাগান করেছিলেন আহসানউল্লাহ।

পানিটোলা
যারা টিন-ফয়েল তৈরি করতেন তাদের বলা হতো পান্নিঅলা। পান্নিঅলারা যেখানে বাস করতেন সে এলাকাকে বলা হতো পান্নিটোলা। পান্নিটোলা থেকে পানিটোলা।

সূত্রাপুর
কাঠের কাজ যারা করতেন তাদের বলা হতো সূত্রধর। এ এলাকায় এককালে অনেক সূত্রধর পরিবারের বসবাস ছিল।

সুক্কাটুলি
১৮৭৮ সালে ঢাকায় বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ ব্যবস্থা চালু হয়। এর আগে কিছু লোক টাকার বিনিময়ে চামড়ার ব্যাগে করে শহরের বাসায় বাসায় বিশুদ্ধ খাবার পানি পৌঁছে দিতেন। এ পেশাজীবীদের বলা হত ‘ভিস্তি’ বা ‘সুক্কা’। ভিস্তি বা সুক্কারা যে এলাকায় বাস করতেন সেটাই কালক্রমে সিক্কাটুলি নামে পরিচিত হয়।

স্বামীবাগ
ত্রিপুরালিংগ স্বামী নামে এক ধনী এবং রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী এক ব্যক্তি এ এলাকায় বাস করতেন। তিনি সবার কাছে স্বামীজি নামে পরিচিত ছিলেন। তার নামেই এলাকার নাম হয় স্বামীবাগ।

[সংগৃহীত]

Visits: 4

মন্তব্য
Loading...
//aitertemob.net/4/4139233