একটি কার্যকর সাংস্কৃতিক বিপ্লব: কিছু কথা না বললেই নয়
আমাদের যারা সব দিক দিয়ে পরিপূর্ণ একটি আদর্শিক সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখি তাদের চিন্তার জগৎটা এতটাই সংকীর্ণ হয়ে যাচ্ছে যে প্রতিটি মূহুর্ত রাজনীতির বাইরে তারা কিছুই ভাবতে পারছে না। অবস্থা এমন হয়েছে যে- দাড়ালে, বসলে, খেতে, ঘুমাতে সবখানে শুধু রাজনীতির বাইরে তারা আর কিছুই দেখতে পারছেনা। রাজনীতির বাইরে আর কোনো সমস্যা থাকতে পারে সেটি যেন স্বীকার করতেও অনীহা।
অথচ রাজনীতির পাশাপাশি সমাজ পরিবর্তণের অন্যান্য উপকরণগুলো নিয়েও যে সমান গুরুত্বের সাথে ভাবতে হবে সেটি উপলব্ধিতে আসছে না। যদিও বা কিছু লোক কালে-ভাদ্রে একটু আধটু ফাল পাড়ছেন, তবে তাদের শিল্প কর্মের মান দেখলে মনে হয় নিছক ভাড়ামি ছাড়া কিছুই নয়। একটি শিল্পকর্ম যদি প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম টিকে না থাকে তাহলে এ ধরনের শিল্পকর্ম প্যারালাইস্ট। শিল্প কর্ম হতে হবে বৈশ্বিক মানে উন্নত। হতে হবে মডারেট ও সার্বজনিন। অধিক সংখ্যক মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য। হতে হবে অতি মাত্রায় প্রফেশনালিজমের আদলে গড়া। তা না হলে দায়সারা গোছের শিল্প কর্ম দিয়ে সমাজ পরিবর্তণ সম্ভব নয়।
মাঝে মাঝে দেখি এখনো কিছু লোক ১৮ শতকের মত অযৌক্তিক ফতোয়াবাজি করে। এখনো যদি সিদ্ধান্ত নেয়া না যায় গানে মিউজিক হবে কিনা..? তাহলে তো বলার কিছু থাকে না। কারণ একটি পরিপূর্ণ সাহিত্য-সাংস্কৃতিক আন্দোলনে থাকতে হবে গান, আবৃত্তি, মুখাভিনয়, নাটক, শর্ট ফিল্ম, ফুল ফিল্ম সব সব কিছু। গানে যদি মিউজিক না থাকে তাহলে সিনেমা বানানো সম্ভব নয়। কারণ সিনেমায় গান থাকবেই। তাছাড়া একটি সিনেমার প্রতি পরতে পরতে রয়েছে মিউজিক। আর সিনেমা মিউজিক ছাড়া বিশ্ব মানের হবে না। তাই ভালো মিউজিক ডিরেক্টর তৈরি করা এখন সময়ের দাবি। এটি অস্বীকার করা আত্মপ্রতারণার শামীল।
আমি মনে করি শিল্প কর্মকে যদি প্রফেশনালীজম না থাকে তাহলে বর্তমানের গ্লোবালাইজেশনের যুগে শিল্প ও শিল্পী কোনোটিই টিকে থাকা সম্ভব নয়। কারণ কিছুদিন পরেই তারা হারিয়ে যাবে কখনো পেটেরে দায়ে কখনো বা নানামুখী সীমাবদ্ধতার কারণে। অথচ নীতিনিধারকদের মধ্য থেকে এটিকে প্রোফেশনালিজমের মধ্যে নিয়ে আসার কোনো প্রচেষ্টা লক্ষ করা যাচ্ছে না। এর মধ্যেও যারা সুস্থ্য সংস্কিৃতির চর্চা করছেন বলে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন তাদের যোগ্যতা থাকলেও রয়েছে অসংখ্য গোড়ামী। আমি এই পর্যন্ত এক জন শিল্পী বা অভিনেতাকে পেলাম না যিনি তার নিজের ভাষা বাংলাকে প্রমিত উচ্চারণে বলতে পারেন। সুতরাং এসব শিল্পী দিয়ে ভাড়ামী ছাড়া আর কি বা হতে পারে? আর এ কারণে তাদের শিল্পকর্মগুলো বিরোধী পক্ষের সীমাহীন শক্তিশালী ও আগ্রাসী অপসংস্কৃতির সামনে ধানের চিটার মত উড়ে যাচ্ছে।
এখানে ভাববার অবকাশ নেই যে আমি রাজনীতির বিরোধীতা করছি। কোনো সমাজে একটি সফল আদর্শিক বিপ্লব তখনই ঘটবে যখন রাজনীতির পাশাপাশি সমাজের প্রতিটি উপাদান বা অনুসঙ্গকেই সেই আদর্শের আদলে রাঙ্গানো যাবে। সে ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দিতে হবে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডকে। আমি জানি আমার এই কথাগুলো নতুন কথা নয়। তবে মূল কথা হলো এখন পর্যন্ত যে ধরনের বা মানের সাংস্কৃকি কর্মকাণ্ড পরিচলনা করা হচ্ছে বা হয়েছে তা দিয়ে বিপরীত দিক থেকে আসা সাংস্কৃতিক আগ্রাসনকে মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। কারণ এগুলোর না আছে কোনো শিল্প মান না আছে আধুনিক বা যুগোপোযোগী চাহিদার আলোকে খাপ খাওয়ানোর মত ক্ষমতা। এ প্রেক্ষপটে আমাদের ভাববার সময় এসেছে আমাদের সংস্কৃতিকে কোন মানে নেয়া দরকার। যারা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড নিয়ে ভাবতে চায় তাদেরকে স্বাধীনভাবে ভাববার সুযোগ করে দিতে হবে। তাদের চিন্তা-চেতনা ও কর্মকাণ্ডকে যদি সবসময় রাজনৈতিক নেত্রীবৃন্দের চিন্তার প্রভাব দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করা হয় তাহলে ব্যুমেরাং হয়ে যাবে। কোনো সাধক বের হয়ে আসবে না। কিছু দিনের জন্য আবেগে পড়ে কিছু মানুষ আসবে। তার পর যথারীতি হারিয়ে যাবে।
সুতরাং আর সমালোচনা নয়, এখনই ভাববার সময় এসেছে আমরা করণীয় কি হওয়া উচিৎ। মোদ্দা কথা হলো অসংখ্য সীমাবদ্ধতার মধ্য থেকেও আমাদের যার যে অবস্থান থেকে এক একটি প্রতিষ্ঠানের মত ভুমিকা নিয়ে হয়ে কাজ করতে হবে।
Visits: 1