নধর

0 ৯০

কার্তিকের সবে মাত্র কয়েক দিন গেল। আর এর মধ্যেই আকাশের গর্ভে জন্ম নেওয়া চাঁদটা ধীরে ধীরে ফুলে ফেঁপে পূর্ণিমা! পূর্ণিমা তিথি নাকি সাগরের বুকে জোয়ার আনে, তবে আজ সে রীতিমতো জোছনার জোয়ার এনেছে। আজ প্রবারনা পূর্ণিমা। সাদা চোখে তাকিয়ে আকাশের যতদূর দেখা যায় মনে হয় গা থেকে এক ধরনের সাদা আভা চুইয়ে পরছে। এক নাগাড়ে তাকিয়ে থাকলে অদ্ভুত এক নেশা ধরে চোখে। মনে হয় আশে পাশে কেউ নেই, কিচ্ছু নেই…। এমনকি পায়ের নিচের মাটি টি পর্যন্তও নেই! শূন্যে ভাসে মন, শূন্যে ভাসে দেহ।
জোছনা আর শিশির মেখে রাত তখন এগারোটা। ধিবর কুলের এই অজপাড়া গায়ে রাত এগারোটা মানে অনেক রাত। প্রতিটি বাড়ির সান্ধ্য ধূপের গন্ধ মিলিয়ে গেছে অনেক আগেই। বহুদূরে ধানক্ষেতে থেমে গেছে শেয়ালের ডাক। নিভু নিভু করতে করতে শেষ প্রদীপটাও নিভে গেল। কিন্তু আকাশের প্রদীপ নেভাবে কে? সোনার ডিমের মত হলুদ চাঁদটি একাকী ঝুলে ঝুলে দুধের মত সাদা আলোয় ভাসিয়ে নিচ্ছে চরাচর। আজ কারো মাছ ধরার তাড়া নেই তাই প্রতিটি বাড়িই ঘুমে শীতল। চাঁদও নিঃশব্দে ঝরাচ্ছে জোছনা।
গাছপালা জড়ানো ঘুমন্ত বাড়িগুলো থেকে বেশ দূরে একটা বিল। বিলের টলটলে পানিতে চাঁদের ছায়া পড়েছে। কিসের এক অদ্ভুত ছোঁয়ায় মায়াজাল তৈরি করেছে পরিবেশ। প্রবারনা পূর্ণিমা আজ। কেউ আজ মাছ ধরবে না, জাল ছুঁয়াবে না জলে। বিলের বুকে এখানে সেখানে দু’একটা শাপলা ফুটেছে। কিন্তু প্রচুর পানিফল আর পানি মরিচ গাছগুলো রীতিমতো ঝোপ তৈরি করে রেখেছে। অত বড় বিলের মাঝে একটুখানি চর জেগেছে আবার। আর মাটির ছোঁয়া পেয়ে তাতেই পানিছনের মাথাগুলো লকলক করে বেড়ে উঠেছে। ছনগুলো ঘেঁষে কালো কালো আবছামত একটা ডিঙ্গি মৃদু মৃদু দুলছে। তারই মধ্যে ক্ষুদ্রকায় দুটো ছায়া। ওদের ফিসফিসে কথার আওয়াজ একটু দূরে এসেই মিলিয়ে যাচ্ছে।
“কি করে এলি রে নধর, আমি তো ভাবছিলাম আসতেই পারবি না”।
জবাব দেওয়ার আগে একগাল হেসে নিল নধর। “নিশান যদি আসতে পারে তবে নধর পারবে না কেন রে? তুই কিভাবে এলি বলতো”
হাতের পলা টা পাটাতনের উপর রেখে নধরের কাছে এসে বসল সে। নৌকাটা ছন গাছে মৃদু একটা আওয়াজ তুলে দুলে উঠল। চারপাশে সতর্ক দৃষ্টিতে একবার দেখে নিয়ে নিশান বলল, “শুনবি…? মেজ জ্যাঠা বাড়িতে আজ। কি যে কষ্টই না হল আসতে। রাত দশটা বেজে গেল অথচ জ্যাঠা ঘুমাচ্ছেই না। ভাবলাম তোরা চলে এসেছিস। জ্যাঠার পাশে চুপ করে শুয়ে রইলাম”। আবার উঠে দাঁড়ালো নিশান। চারপাশে তাকিয়ে একটা ছন ছিঁড়ে আঙুলে পেঁচাতে লাগল। বলল, “অনেক পরে জ্যাঠা ঘুমাল ঠিকই কিন্তু শুরু হল আরেক ঝামেলা। নাক ডাকা। দরজা পর্যন্ত উঠে এসে নাকডাকার আওয়াজে মনে হল এই বুঝি ঘুম ভেঙ্গে গেল। আবার ফিরে গেলাম। আবার উঠি, আবার যাই। এভাবে অনেকবার”। হাতের ছনটি ছুড়ে ফেলে বিরক্তি ঝাড়ল নিশান। নধর দাঁত বের করে হাসছে। ওর কুচকুচে কালো দেহে হাসিটা ঠিক চাঁদের মতই। জোছনার আলোয় দাঁত গুলো মাঝে মাঝে ঝিক্ করে উঠে। গামছামত কিছু একটা কোমরে জড়িয়েছে সে। বাকিটুকো উদোম। চাঁদের আলো ওর কাঁধ দুটো ধুয়ে দিচ্ছে যেন। অপূর্ব লাগছে ওকে। জগতের সবচাইতে নিষ্পাপ মনে হচ্ছে। অবাক হয়ে ওর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আবার বলতে লাগল নিশান, “শেষমেশ এলাম। কিন্তু বর্শা টা আনতে পারলাম না। সামনে পলা ছিল তাই নিয়েই দৌড় দিয়েছি”।
“সেকি! বর্শা আনিসনি? আমারটা তো ভেঙ্গে গেছে, আমিও আনিনি……”।
“থাক শিবাকে আনতে বলেছি”।
“আচ্ছা নিশান, তোর কি মনে হয় শিবা আসবে?”
“আসবে। তবে ওকে তোর সাথে করে আনা উচিৎ ছিল। হাজার হোক ওদেরই ডিঙ্গি। আর ওকে সাথে নেওয়ার শর্তেই ডিঙ্গি দিতে রাজি হয়েছে”।
“ প্রথমে তো ওদের বাড়িই গিয়েছিলাম। আলো জ্বলতে দেখে আর ডাকার সাহস পাইনি”।
বাঁশের লগিটা নিজের হাতে নিয়ে নধরকে পলা তুলে দিল নিশান। পানিতে খোঁজ মেরে আস্তে আস্তে নৌকাটা সরাতে লাগল।
ঝোপের আড়াল থেকে বেরিয়ে পড়ল ডিঙ্গি।
“এবার তুই বল কেমনে এলি?”
আবার হাসল নধর, “আমার আবার আসা কিরে, আমি তো রোজই আসি। আমার তো আর কেউ নেই যে বাঁধা দেবে। তাও পূর্ণিমা বলে কথা, মা থাকলে হয়তো বাঁধা দিত, কিন্তু মা তো নেই……”
চাঁদের দিকে তাকিয়ে আছে নধর। অসম্ভব সুন্দর লাগছে ওকে। বুঝি ভুল করে আকাশের একটা তারা এইখানে রেখে গেছে কেউ। মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে নিশান। হঠাৎ ওর চোখের নিচে চিক্ চিক্ করতে দেখল। গত বছর এই রাতেই মারা গেছে ওর মা। নিশান ওকে সান্তনা দিতে চাইল কিন্তু কথা এলো না মুখে। হঠাৎ দূরে একটা আলোর সংকেত চোখে পড়ল। শিবা এসেছে, ওদের ডাকছে। ওরা ডিঙ্গিটা ধীরে ধীরে বাইতে লাগল।

একটা জল ডুমুর গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছে শিবা। পরনের ফ্রকটা হাঁটু পর্যন্ত নেমেছে। উদোম পায়ে কোন জুতো নেই। বেশ অন্ধকার এখানে। পাশেই শিয়ালমতি ঝোপের তীব্র ঝাঁঝালো গন্ধ আর ঝিঁঝিঁর একটানা গানে মাখামাখি সব। গাছের ফোঁকর দিয়ে নেমে আসা চাঁদের আলোয় বর্শার ধাতব অংশ ঝিক্ ঝিক্ করছে মাঝে মাঝে। দূর থেকে ওর আদলটা কেমন ভূতুড়ে লাগছে। নিশানরা খুব সাবধানে একটা ঝোপের কাছে ডিঙ্গি ভেড়াল। ওদের দেখে কিছুটা তৎপর হল শিবার চোখ দুটো কিন্তু অন্ধকারে তা বুঝা গেল না। লাফ দিয়ে ডিঙ্গিতে চড়তে যাবে সে। নধর বলল, “দাড়া শিবা, তুই এখন একটু জিভটা বের কর, দেখবি মা কালী হয়ে গেছিস”।
কথাটা বলেই জোরে জোরে হেসে উঠল নধর। শিবা তাড়াতাড়ি ঠোঁটে আঙ্গুল ছুঁয়াল। পেছনে এক পলক তাকিয়ে লাফ দিয়ে উঠে বসল ডিঙ্গিতে। ফিসফিস করে বলল, “চুপ! মা জেগে আছে”
শিবার নৌকায় উঠার ধরন বলে দেয় সে এই কাজে অভ্যস্ত। নিঃশব্দ আর ক্ষিপ্রতায় দুজনের চেয়ে সেরা। লগি বাইছে নধর। অতি সন্তর্পণে লগির এক একটি খোজ দেয় আর নিঃশব্দে ডিঙ্গিটা এগিয়ে চলে সামনে। বিলের কালো জলে সাদা সাদা শাপলাগুলো তারার মত হাসছে। আর ভরা চাঁদের আলো নিঃশব্দে চুমু খাচ্ছে তাদের। গলুইয়ের উপর পা ছড়িয়ে বসেছে নিশান। বর্শাটা পাটাতনে রেখে ডিঙ্গির একপাশে সরে বসল শিবা। সবাই চুপ হয়ে আছে। ঢাউস একটা শাপলার দিকে আঙ্গুল দেখাল শিবা। নধর নৌকাটা কাছে নিতেই হাত বাড়িয়ে তুলে আনল শাপলাটা। হঠাৎ একটা ব্যাঙ লাফিয়ে উঠতেই ঈষৎ কেঁপে উঠল শিবা। পরক্ষনেই খিলখিল করে হেসে উঠল। মনে হল একশটি কাঁচের চুড়ি শানের মেঝেতে পড়ে ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল। ওর হাসিতে বাকি দুজন যেন স্বস্তি পেল। কবরের নিস্তব্ধতা কারো ভাল লাগেনা। আকাশের দিকে তাকিয়ে নিশান বলল, “পূর্ণিমা রাতে গলা খুলে গান গাইলে নাকি সাপেরা মানুষের বশ হয়ে যায়। তবে সে গানে সুর থাকা চাই”।
একের পর এক শাপলা তুলে যাচ্ছে শিবা। নিশানের কথায় হঠাৎ উঠে দাঁড়াল। কাছে এসে আস্তে করে বসে ফিসফিস করে বলল, “ সত্যিই কি পূর্ণিমা রাতে পরীরা আসে, আজ কি আসবে?”
শিবার দিকে তাকাল নিশান। ও এতোটা সুন্দর আগে কখনও বুঝেনি সে। অদ্ভুত মায়াবী লাগছে ওকে। চাঁদের আলোয় সব মেয়েদেরই বুঝি অমন মায়াবী লাগে।
এই মুহূর্তে ওকে কিছু একটার সাথে তুলনা করা যায় কিন্তু সেই কিছুটা মনে আসছে না ওর। এক গাল হেসে নিয়ে নধর বলল, “ পরী আসবে না কিরে, পরী তো এইখানে, ডিঙ্গিতে……”
ঠিক বলেছে নধর। এই কথাটাই সে মনে করতে চাইছিল। নধরের মুখ থেকে কথাটা বের হওয়ায় মনে মনে একটা খোঁচা খেল নিশান।
এতক্ষণে নৌকাটা পানিছন ঘেরা সেই চরের কাছে চলে এসেছে। ধীরে ধীরে সেটি আবার ডানে মোড় নিল। বিলের ডান দিকটা সোজা হয়ে পরীর খালের সাথে মিশে গেছে। পরীর খাল আর বিলের মোহনায় পূর্ণিমা রাতে প্রচুর মাছ পড়ে। আজ অন্য কোন জেলে থাকবে না। শান্তিতে মাছ ধরতে পারবে ওরা। তবে মাছ ধরাই ওদের আসল উদ্দেশ্য নয়। পরীর খালের মোহনায় প্রতি পূর্ণিমা তিথিতে নাকি দল বেঁধে পরীরা আকাশ থেকে নেমে আসে। চাঁদের আলো গায়ে মেখে তারা পানিতে সাঁতার কাটে। মূলত তাই দেখতেই ওরা এসেছে।
হঠাৎ করেই যেন সবাই চুপচাপ হয়ে গেল। এতক্ষণ যে তিরতিরে বাতাস ছিল তাও থেমে গেছে। ওদের ফিসফিসে আওয়াজও বন্ধ। কোথাও এতটুকও শব্দ নেই। শুধু জলের ভেতরে চাঁদটা সহস্র খণ্ডে ভেঙ্গে ভেঙ্গে যায়। ধীরে ধীরে কাছে চলে আসছে পরীর খাল। বড় বড় কাশ- ছন আর নলখাগড়া জন্মেছে প্রচুর। তারই ফাঁকে ফাঁকে নধর এমন কৌশলে ডিঙ্গি বাইছে যে মনে হচ্ছে নিচে পানি নেই, মেঘ। নিশানের দিকে চোখ পড়তেই ইশারায় তাকে ডাকল সে। নিঃশব্দে উঠে এল নিশান। লগিটা নিজের হাতে নিয়ে নধরের জায়গায় বসল। পাটাতনের উপর থেকে বর্শাটা তুলে নিয়ে নধর গলুইয়ে দাঁড়াল। মাছ ধরায় সে হাত পাকা। গলুইয়ের সামনে দাঁড়িয়ে নধর। চোখে তার শিকারির একাগ্রতা। বর্শা তাক করা হাত দুটো কেবল অপেক্ষায় আছে। নির্জন বিলের গাঢ় নিস্তব্ধতায় একটু কেঁপে উঠল শিবা। মরা জোছনার আলোয় নধরের এই শিকারি মূর্তিটা কেমন যেন ভূতুড়ে লাগছে ওর। আস্তে করে সে নিশানের পাশে সরে এলো। বাঁয়ে হঠাৎ ছনের মাথাগুলো নড়ে উঠল, আর মুহূর্তেই নধরের দেহখানা ধনুকের মত টানটান হয়ে গেল। তারপর বিদ্যুৎ চমকের মত কেঁপে উঠল সে এবং ক্ষিপ্র হাত থেকে বর্শাটা তীরের মত বেরিয়ে গেল। একটু পরে ঢাউস একটা মুখ হা করা শোল তুলে আনল নৌকায়। মুখে চাঁদের মত সেই হাসি নধরের। মাছটা সীসার একটা পাতিলে রেখে আবার দাঁড়াল গলুইয়ের সামনে।
বেশ কিছুক্ষণ পরেই পাতিলটি ভরে গেল। কিন্তু ওদের চোখ পরীর খালের দিকে। কিছু একটা দেখার একাগ্রতা চোখের ভিতর। চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে চরাচর। কিন্তু ঝিলমিল করে কেউ নামছে না আকাশ থেকে। গলুইয়ের সামনে দাঁড়িয়ে আছে নধর। হাত অনেকটাই শিথিল। মাছের প্রতি আগ্রহ নেই আর। ধীরে ধীরে কেটে যাচ্ছে মুহূর্ত। হঠাৎ বুকের রক্ত হিম করে দিয়ে চিৎকার করে উঠল নধর। ডিঙ্গি থেকে ধপাস করে পড়ে গেল পানিতে। পানির উপর ঝুপ্ ঝুপ্ দুটো শব্দের মধ্যেই হারিয়ে গেল ওর চিৎকার। তলিয়ে গেল নধর।
ব্যাপারটা বুঝতে কয়েক মুহূর্ত সময় লাগল নিশানের। দুই পাশে দুটি মাথা ভুস্ করে ভেসে উঠেছে। এক চিৎকার দিয়ে শিবাকে ঠেলে দিল ডিঙ্গির মাঝখানে। নিজেও সরে এলো তড়িতে। দুটো নয়, তিনটে নয়, দশ বারোটা কুমীরের মাথা ধেয়ে আসছে। দম বন্ধ হয়ে এলো নিশানের। ঊর্ধ্বশ্বাসে ডিঙ্গিটা বাইতে লাগল। পেছনে তীরের মত ছুটে আসছে অনেক গুলো মাথা। শিবা দুর্বোধ্য ভাষায় চিৎকার করে কাঁদছে। কিছুই কানে ঢুকছে না তার। সে অসম্ভব ক্ষিপ্রতায় নৌকাটা বাইছে, শুধু বাইছে…।
ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে ছোট্ট ডিঙ্গিটা। কমে আসছে কান্নার আওয়াজ। পরীর খালের মোহনা আবার স্তব্ধ হয়ে গেল। আবার হাওয়া শূন্য স্তব্ধতায় বিল নিথর হয়ে গেল। পানির উপর ছন গাছের মৃদু মৃদু কম্পন থেমে গেল। পরিবর্তন কেবল পানির রঙ। ধীরে ধীরে পানি লালচে হয়ে যাচ্ছে আর তার উপর ঝরে পড়ছে জোছনা। নিঃশব্দে, অতি নিঃশব্দে। বহুদূরের কোন জল ডুমুর গাছের তলা থেকে ভাঙ্গা ভাঙ্গা শব্দে কেবল ভেসে আসছে “নধ…র,- ন…ধ…র” । জলের উপর ঝরে পড়া জোছনারাও যেন সেই প্রতিধ্বনি কেঁদে কেঁদে ছড়িয়ে দিচ্ছে নির্জন বিল জুড়ে।

Visits: 9

মন্তব্য
Loading...
//grunoaph.net/4/4139233